ধরা যাক আপনি খুব অসাধারণ মানের একজন লেখক। যেকোন বিষয়ে, যেকোন ব্যাপারে কালজয়ী সাহিত্য রচনা করে ফেলাটা আপনার হাতের খেল। আরো ধরা যাক, সাহিত্য রচনার জন্য আপনাকে দেওয়া হলো তেইশ বছর সময়। এই তেইশ বছরে আপনি যে মাস্টারপিস রচনা করবেন, তারজন্যে আপনাকে দেওয়া হবে পৃথিবীর সেরা লেখকের খেতাব। শর্ত হলো এই দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে আপনাকে একেবারে একটানা লিখে যেতে হবে।

আচ্ছা, আবার ধরা যাক, এই দীর্ঘ সময় অতিক্রমকালে একদিন হঠাৎ করে আপনার আপন চাচা, যিনি আপনাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন, যিনি আপনার মাথার ওপরে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এতোদিন, তিনি মারা গেলেন। আপনার সবচেয়ে কাছের অভিভাবক ছিলেন আপনার এই চাচা। তার কাছেই আপনি বড় হয়েছেন। এখন, হঠাৎ করে আপনার এই প্রাণপ্রিয় চাচাকে হারিয়ে, আপনি নিশ্চয় খুব ভেঙে পড়বেন, তাইনা? এটাই স্বাভাবিক কিন্তু।

তো, আপনার কাজ তো লেখা। আপনাকে লিখতেই হবে৷ আচ্ছা, আপনার এই যে প্রিয়তম চাচা মারা গেলেন, এর কোন প্রভাব কি আপনার লেখায় পড়তে পারে? পড়াটাই স্বাভাবিক। আপনি আপনার চাচার স্মৃতিচারণ করে কালজয়ী একটা উপন্যাসও লিখে ফেলতে পারেন। কিভাবে আপনাকে তিনি বড় করেছেন, কতো অসাধারণ মানুষ ছিলো এই মানুষটি, ইত্যাদি চিত্রপটে আপনি রচনা করে ফেলতে পারেন একটি অনন্য শিল্পকর্ম। এটাই কিন্তু স্বাভাবিক।

আবার, এরকিছুদিন যেতে না যেতেই, ধরা যাক, আপনার স্ত্রী মারা গেলো। একেবারে অকস্মাৎ! আহা! চাচার শোকস্মৃতি কাটিয়ে-ই উঠতে পারলেন না, সেখানে নতুন বিচ্ছেদের শুরু। আপনার প্রিয়তমা স্ত্রী, যাকে আপনি সুখে-দুঃখে সবসময় কাছে পেয়েছেন, পাশে পেয়েছেন, যে আপনার জন্য সাহসের বাতিঘর হয়ে ছিলো, হঠাৎ করে তার মৃত্যুতে আপনি নিশ্চয় ভড়কে যাবেন, তাই তো? স্বাভাবিক।

এখন, আপনার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য আপনি কি একটা উপন্যাস-ও লিখবেন না? নিদেনপক্ষে একটা কালজয়ী বিরহের কবিতা? এতোবড় লেখক আপনি, এরকম বিরহ-বিচ্ছেদে একটি কালজয়ী সৃষ্টিই যদি না লিখতে পারেন, কিভাবে হয়?

আবার ধরা যাক, একে একে মারা গেলো আপনার সব ক’টা পুত্র সন্তান। একেবারে সব ক’টাই। উফফ! কি দুঃসহ যন্ত্রণাই না আপনার জন্যে, না? সত্যিই!

এমন দুঃখ আর কষ্টের মাঝে দাঁড়িয়ে, শোকের এমন সাগরে অবগাহন করে, এমন কঠিন পুত্র-বিয়োগের ব্যথায়, আপনি নিশ্চয় লিখে ফেলবেন কোন কালজয়ী মর্সিয়া সঙ্গীত, তাই না? আপনি যেহেতু খুব অসাধারণ, বড় মানের লেখক, আপনার জন্য এটাই কিন্তু স্বাভাবিক।

একজন মানুষের জন্য, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, উপরের সব’কটা কাজ স্বাভাবিক। যদি শর্তগুলো পূরণ হয়। মানে, উনি যদি খুব বড় মানের লেখক হোন। উনার হাতে যদি তেইশ বছরের মতোন দীর্ঘ সময় থাকে।

আচ্ছা, এবার আরেকটা দৃশ্যপট ভাবুন তো।

নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়াত লাভের পর প্রিয়তম চাচা আবু তালিবকে হারিয়েছেন। চাচার মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পর মারা যান তার প্রিয়তম সহধর্মীনি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা। আর, এর আগে-পরে মারা যায় নবিজীর সব ক’টা পুত্র সন্তান।

তিনটা বি-রা-ট শোকের গল্প!

অথচ, দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে যে কুরআন নাযিল হয়েছে, তাতে এই তিনটে ঘটনার শোকের আবহ নিয়ে কোন একটা আয়াতও নেই। একজন খ্যাতিমান লেখক দীর্ঘ তেইশ বছর সময় পেলে, ওই সময়ে যদি তার সাথে এরকম ঘটনা ঘটতো, সেখানে যখন সে এই ঘটনাগুলো নিয়ে লিখে ফেলতো কালজয়ী নাটক, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, সঙ্গীত, সেখানে, একই টাইম স্কেল, একই ঘটনা, একই শোক, একই দুঃখের ভিতর দিয়ে যাওয়ার পরেও, কুরআনে এই সংক্রান্ত কোন একটা শোকের আয়াতও নেই। ভাবা যায়?

কুরআন যদি মানব-রচিত হতো, নাস্তিকদের দাবি অনুযায়ী, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি কুরআন লিখে থাকতেন (নাউযুবিল্লাহ), তাহলে এই তিনটে ঘটনা নিয়ে কুরআনে কম করে হলেও তিনটে সুরা থাকতো।

একজন মানুষ যদি নিজ থেকে কুরআন লিখতো, জীবনের এই তিনটে বড় ঘটনার প্রভাব সেখানে অবশ্যই অবশ্যই থাকতো। এটাই মানবীয় বৈশিষ্ট্য যা এড়িয়ে যাওয়া কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বড় বড় লেখক, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে টলস্টয়, শেলী থেকে শুরু করে শেক্সপিয়ার, সবার রচনার মধ্যে তাদের জীবনের এমন বড় বড় ঘটনা তো অবশ্যই, জীবনের ছোট ছোট ঘটনাও বাদ যায়নি। সেগুলো নিয়েও তারা লিখে গেছেন গল্প-কবিতা-গান। লিখে গেছেন কালজয়ী উপন্যাস।

কিন্তু দেখুন, কুরআন কী ব্যতিক্রম! মুহাম্মদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের এই তিনটি বড় শোকের ঘটনার কোন আলোচনা, কোন প্রভাব আমরা দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে টানা নাযিল হওয়া কুরআনে দেখতে পাই না।

এর দ্বারা কি প্রমাণ হয়?

কুরআন কোন মানব-রচিত গ্রন্থ নয়। এটা যদি মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখতেন, তাহলে সেখানে আমরা উপরের এই ঘটনাগুলোর ছায়া দেখতে পেতাম। এগুলো নিয়ে শোক-স্মৃতির রোমন্থন দেখতে পেতাম। কিন্তু, কুরআন যেহেতু আল্লাহর কালাম, তিনি এখানে মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখকে স্থান দেননি। তিনি সেটার দরকার মনে করেন নি। কুরআন একটি ঐশী গ্রন্থ যা জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপরে নাযিল হয়েছে ক্রমান্বয়ে।

আরিফ আজাদ
আরিফ আজাদ

আরিফ আজাদ একজন লেখক এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। ২০১৭ সালে 'প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ' বইয়ের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। লিখেন বিশ্বাসের কথা, চূর্ণ করেন অবিশ্বাসের আয়না। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ঘুরতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন।

Articles: 46

19 Comments

  1. 1. specific কিছু দুঃখের ঘটনা বর্ণিত নেই তাঁর মানে এই না যে সেটি অলৌকিক

    2. যে সকল কবিদের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের গ্রন্থের সংখ্যা ২০-৩০ বছরের মধ্যে ১টি না , একাধিক বই আছে তাদের যেখানে এক এক timeline এ এক এক ঘটনা বর্ণিত-একটি গ্রন্থেই গোটা জীবনী বর্ণনা করেন নি ।

    3. if there is a supreme being like Allah or something like that – তাদের/তাঁর কোন বই নাজিল করার দরকার পরবে না। তিনি সর্বশক্তিমান , তিনি চাইলেই মানুষের brain এ এসব দুখিয়ে দিতে পারতেন !

    এমন logical fallacy প্রায় সব educated ধার্মিকরাই দেয় !








    • ﭿ





      ﮅﮆ



      ﮊﮋ










      ﮖﮗ
















      ﮨﮩ





      যদি কোন কুরআন এমন হত, যার দ্বারা পর্বতকে গতিশীল করা যেত অথবা পৃথিবীকে বিদীর্ণ করা যেত অথবা মৃতের সাথে কথা বলা যেত, (তবুও তারা তাতে বিশ্বাস করত না)। বরং সমস্ত বিষয়ই আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত।[১] তবে কি যারা বিশ্বাস করেছে তাদের প্রত্যয় হয়নি যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিশ্চয় সকলকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতেন; যারা অবিশ্বাস করেছে তাদের কর্মফলের জন্য তাদের বিপর্যয় ঘটতেই থাকবে অথবা বিপর্যয় তাদের আশে পাশে আপতিত হতেই থাকবে;[২] যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর প্রতিশ্রুতি এসে উপস্থিত হবে।[৩] নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না।

    • যদি কোন কুরআন এমন হত, যার দ্বারা পর্বতকে গতিশীল করা যেত অথবা পৃথিবীকে বিদীর্ণ করা যেত অথবা মৃতের সাথে কথা বলা যেত, (তবুও তারা তাতে বিশ্বাস করত না)। বরং সমস্ত বিষয়ই আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত।[১] তবে কি যারা বিশ্বাস করেছে তাদের প্রত্যয় হয়নি যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিশ্চয় সকলকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতেন; যারা অবিশ্বাস করেছে তাদের কর্মফলের জন্য তাদের বিপর্যয় ঘটতেই থাকবে অথবা বিপর্যয় তাদের আশে পাশে আপতিত হতেই থাকবে;[২] যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর প্রতিশ্রুতি এসে উপস্থিত হবে।[৩] নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না। (সূরা রা’দ আয়াত ৩১)

  2. ইনশাআল্লাহ এই কুরআন থেকেই ্যেন নিজের জীবন সাজাতে পারি।

  3. স্যার। জানিনা আপনি পর্যন্ত আমার লিখাটি পোছাবে কিনা।একজন নাস্তিক আছে নাম আসাদ নুর। উনার করা এক্তা ভিডিওতে উনি জান্নাতের বর্ণনা নিয়ে লেখা বিভিন্ন আয়াত নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। যুক্তি আছে বটে।যদি আপনি এ ব্যাপারে কিছু বলতেন খুব উপকার হত। স্যার

  4. Ma Sha Allah খুব ভালো করে explain করেছেন।
    জাযাকাল্লাহু খাইরান ❤️✨💢🌸✍️

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *