ফিলিস্তিনের গোলাপ

১.

‘ওয়ার অন টেরর’ নামের একটা পাউরুটি ঝুলিয়ে দিয়ে অ্যামেরিকা পুরো দুনিয়াতে মুসলিম নিধন এবং মুসলিম-নির্যাতনের লাইসেন্স তৈরি করে নিয়েছে। যেখানেই মুসলমান সেখানেই সন্দেহ। যেখানেই দাঁড়ি-টুপি, সেখানেই আঁড়ি পাতা। অবস্থা এমন যে—মুসলমান হলেই আপনি অচ্ছুৎ। আপনার গা থেকে সর্বদা সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী গন্ধ বেরোয়।

৯/১১ এর যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে অ্যামেরিকা দুনিয়ার বুকে ওয়ার অন টেরর তকমা উৎপাদন করেছিলো সেই ঘটনাকে নিয়ে খোদ আমেরিকাতেই অনেক হাইপোথিসিস আছে। সবকিছু একপাশে রেখে, ওটাকে যদি ইশ্যু করবার মতোন একটা ঘটনা হিশেবে ধরেও নিই, এরচাইতেও মারাত্মক এবং বিধ্বংসী ঘটনা পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রের গায়ে আর বহু ধর্মের গায়ে লেপ্টে আছে। এক হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা ছোঁড়ার ইশ্যুটাই তো কিয়ামত পর্যন্ত অ্যামেরিকাকে ‘সন্ত্রাসী’ বানানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু না, আমেরিকার শুভ্র সফেদ গায়ে সে তকমা কখনোই দেওয়া যাবে না। তারা দুনিয়ার বুকে শান্তিকামী, সাম্যবাদী, ন্যায় আর মানবতার অতন্দ্র প্রহরী হয়েই বেঁচে থাকতে ভালোবাসেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোন মুসলমানের কারণে সংঘটিত হয়নি। পৃথিবীর বড় বড় গণহত্যাগুলোর সাথে যাদের নাম জড়িয়ে আছে, আজকের দুনিয়ায় তারাই শান্তিকামী হিশেবে প্রতিষ্ঠিত। জাতিসংঘের সভাগুলোতে আজকে তারাই আমাদেরকে সবক দেয় শান্তি, সাম্য আর সুবিচারের। তারা মানুষ খুন করবে, মানুষের ঘরবাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে, মানুষকে শোষণ করবে দিনের পর দিন, কিন্তু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ চলবে কেবল মুসলমানদের বেলাতে। দুনিয়ায় যা বিপর্যয়, যা অশান্তি আর অন্যায্য, সব তো মুসলমানরা ঘটায়। বাকিরা দুধে ধোয়া তুলসী পাতা!

২.

‘মুসলমানদের জ্ঞানে-বিজ্ঞান চর্চা বাড়াতে হবে, নচেৎ কেবল পাথর ছুঁড়ে আর দুয়া করে অ্যামেরিকা-ইসরাঈলকে ঘায়েল করা সম্ভব না’।

কথাটা সুন্দর, কিন্তু উপদেশটা যথার্থ না। মুসলমানরা বিজ্ঞান চর্চা বাড়াতে না পারার পেছনে কি কেবল ‘মুসলমানরাই’ একচ্ছত্রভাবে দায়ী?

একটা গোষ্ঠীকে ‘ওয়ার অন টেরর’ তকমার আওতায় এনে কোণঠাসা করে রাখবেন, আতশবাজির মতো করে দিনরাত তাদের ঘরবাড়ির ওপরে বোমা ফেলবেন আর আশা করে থাকবেন যে তারা তাদের চোখ-মুখ ল্যাবরেটরির অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ডুবিয়ে রাখবে? সম্ভবত, জীবন এতোটা সহজ আর সাবলীল নয়।

আপনি বলতে পারেন, ওয়ার অন টেরর তো সেদিনের ইশ্যু, এর আগে কি তবে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বজয় করেছিলো?

ওয়ার অন টেরর ইশ্যু নাহয় কাল-পরশুর, কিন্তু বিজ্ঞান, ক্ষেত্রবিশেষে শত্রুকে জবাব দেওয়ার জন্য যে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সক্ষমতা দরকার, সেই সক্ষমতা অর্জনে মুসলমানদের দমিয়ে রাখবার চক্রান্তটা সম্ভবত আজ-কালকের নয়, বহু পুরোনো। মোসাদ কর্তৃক ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরান-আফগানিস্তানের বিজ্ঞানীদের হত্যার অভিযোগটাও অনেকটা প্রতিষ্ঠিত বিষয়।[১] [২]

স্বীকার করছি মুসলিমদের নিজেদের উদাসীনতা, নিজেদের মধ্যকার দলাদলি-কোন্দল বিজ্ঞান চর্চায় তাদের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ, কিন্তু বিশ্ব-মোড়লদের পরোক্ষ দায়টাকেও এখানে ছোট হিশেবে দেখার সুযোগ নেই। মধ্যপ্রাচ্য সহ মুসলিম দেশে দেশে যে অস্থিরতা, সেই অস্থিরতা টিকিয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নেওয়া গোষ্ঠীটা কীভাবে চাইবে যে, শত্রুপক্ষ তার সমান সক্ষমতা লাভ করুক?

৩.

ইসরায়েল ফিলিস্তিনে স্মরণকালের সবচেয়ে বিধ্বংসী ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। দিন কয়েক আগে শুরু করা বর্বরতায় নারী এবং শিশুসহ এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দুইশো’রও বেশি। ঘণ্টাখানেক আগেই তারা একেবারে ঘোষণা দিয়েই ফিলিস্তিনে থাকা আল-জাজিরা সহ বৈশ্বিক মিডিয়াগুলোর অফিস বোমা মেরে গুড়িয়ে দিয়েছে।

আপনি চিন্তা করুন— বাক স্বাধীনতা, মত-প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলতে বলতে যারা হয়রান হয়ে যায়, তাদেরই এক জানে-জেগার দোস্ত-রাষ্ট্র বিশ্ব-মিডিয়ার একটা অফিস গুড়িয়ে দিয়েছে ঘোষণা দিয়ে! কিন্তু তবুও, আপনি সেই ইসরাইলের পক্ষেই সাফাই গাওয়া দেখবেন। তাদেরকে বিজ্ঞান-বান্ধব, উদার, গনতন্ত্রমনা, আধুনিক সহ নানান তকমা দিয়ে মহান আর গরীয়ান করে না তুললে আপনার চারপাশে থাকা সেক্যুলার-আধা সেক্যুলার-নাস্তিকদের জাত চলে যায়। এরা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করতে চায় না, কিন্তু ইসরাইল-অ্যামেরিকার পারমানবিক শক্তিকে পূজো দিতে এরা সদা-সর্বদা প্রস্তুত।

৪.

ইসরায়েলের আক্রমণের বিপরীতে হামাস এবার অন্তত কিছুটা হলেও পাল্টা আক্রমণের দিকে ঝুঁকেছে। দিন কয়েক আগে হামাসের রকেট হামলায় তেল আবিব সহ ইসরায়েলের অনেক শহর বেশ ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়ে।

আমাদের কিছু সুশীল শ্রেণীর লোকেরা বলছেন, এমন ধারার আক্রমণ করে হামাস নিজের বিপদ বড় করা ছাড়া আর কিছুই করছে না। ইসরায়েল যদি পূর্ণ শক্তি নিয়ে ফিলিস্তিন আক্রমণ করে, রাতারাতি তারা ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবে। যেহেতু ইসরায়েলের সাথে লড়বার সক্ষমতা নেই, হামাসের উচিত নয় এ-ধরণের আক্রমণগুলোতে যাওয়া।

তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, ইসরায়েলের আর্মিরা এতোদিন গোলাপ ফুল, চকোলেট আর নীল খামে ভরা প্রেমপত্র নিয়ে ফিলিস্তিন সীমান্তে মধুর অপেক্ষায় থাকতো আর ফিলিস্তিনীদের দেখামাত্রই ভালোবাসা নিবেদনে ব্যাকুল হয়ে পড়তো। এই প্রথম ফিলিস্তিনীদের কোন আচরণে ইসরায়েল মনে অনেক কষ্ট পেয়েছে এবং প্রতিক্রিয়া হিশেবে ভালোবাসার মানুষটিকে কুসুম কুসুম আঘাত করছে!

আমি অবাক হয়ে যাই, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান নামক একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে, যারা ওই সময়ে ইউরেনিয়াম প্রযুক্তি রপ্ত করে ফেলেছে, তাদের সাথে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিলো, সেই যুদ্ধের সময়ে এসব সুশীলেরা বর্তমান থাকলে কী ফতোয়া দিতো? তারা কি বলতো— পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী দেশ, যারা আবার অ্যামেরিকার মিত্র-রাষ্ট্র, তাদের সাথে যুদ্ধ জড়ানো মোটেই উচিত হবে না?

ইনসাফের লড়াইয়ে সবচেয়ে যেটা বেশি জরুরি সেটা হলো সাহস। রাত্রিবেলায় মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া একটা জাতিকে আপনি উপদেশ দিচ্ছেন শত্রুর দিকে পাথর না ছুঁড়ে, তার গুলিকে বুকে পেতে নিতে? এটাই আপনাদের সাম্যবাদী লড়াই আর মানবতার মূল সবক?

৫.

ইসরায়েলের বোমায় গুঁড়িয়ে যাওয়া একটা বারো তলা ভবনের মালিক তার স্বপ্নের বাড়িটার ধ্বংসস্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে বলেছে— এই ত্যাগকে আমি এই লড়াইয়ের জন্য উৎসর্গ করে দিলাম!

কী অপরিসীম সাহস! কী অসাধারণ মনোবল!

গুলিতে, বোমায়, আঘাতে আঘাতে ঝাঁঝরা হওয়ার পরেও যারা দলবেঁধে আল-আকসাতে আসে, যে জাতির নারীরা তাদের সন্তানদের জন্মের পর থেকেই লড়াইয়ের দীক্ষা দিয়ে বড় করে, আপনি কি বিশ্বাস করেন না তাদের ছোঁড়া পাথরগুলো একদিন সেই পাথরের মতো হয়ে উঠবে যে পাথরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিলো আবরাহার অতিকায় হস্তিবাহিনী? আমরা বিশ্বাস করি— ফিলিস্তিনে আবারও গোলাপ ফুটবে।

ফিলিস্তিনের জন্য অফুরান ভালোবাসা। আমাদের দেহ আর দেশ ভিন্ন, কিন্তু আত্মার উৎসটা তো এক। আল মাহমুদ লিখেছিলেন:

আমাদের এ মিছিল নিকট অতীত থেকে অনন্তকালের দিকে

আমরা বদর থেকে ওহুদ হয়ে এখানে,

শত সংঘাতের মধ্যে এ কাফেলায় এসে দাঁড়িয়েছি।

কে প্রশ্ন করে আমরা কোথায় যাবো ?

আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্তকালের।

উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোনদিনই বিহ্বল করতে পারেনি।

আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,

আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মুতার প্রান্তর।

পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত,

তার সুগন্ধ আমাদের নিঃশ্বাস বায়ু।

আমাদের হাতে একটিমাত্র গ্রন্থ আল কুরআন,

এই পবিত্র গ্রন্থ কোনদিন, কোন অবস্থায়, কোন তৌহীদবাদীকে থামতে দেয়নি।

আমরা কি করে থামি?

আমাদের গন্তব্য তো এক সোনার তোরণের দিকে যা এই ভূ-পৃষ্ঠে নেই।

[1] https://cutt.ly/VbHKQco

[2] https://cutt.ly/vbHKKQr

আরিফ আজাদ
আরিফ আজাদ

আরিফ আজাদ একজন লেখক এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। ২০১৭ সালে 'প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ' বইয়ের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। লিখেন বিশ্বাসের কথা, চূর্ণ করেন অবিশ্বাসের আয়না। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ঘুরতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন।

Articles: 46

19 Comments

  1. মাশাল্লাহ ভাইজান আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর চমৎকার বাক্য চয়ন আপনার যখন পরী মনে হয় হারিয়ে যাই।
    সত্যিই আপনার কথাগুলো বাস্তবতার সাথে পুরোটাই মিল রাখে।🇵🇸🇵🇸🇵🇸🇵🇸😭😭❤️
    এগিয়ে যান ভাইজান দোয়া রইলো আপনার জন্য। বিশেষ করে আমাদের জন্য দোয়া রাখবেন।
    আপনাকে” বিশাল একটা জাজাকাল্লাহ ”
    হাদিয়া হিসেবে দিচ্ছি ফেরত দিবেন না প্লিজ!

  2. মা শা আল্লাহ
    অসাধারণ
    আল্লাহ তুমি আমাদের সকল মুসলমানদের অন্তরের চক্ষু খুলে দাও এবং জিহাদ সামিল হওয়ার তাওফিক দান করুন।

  3. রাত্রিবেলা মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া একটা জাতিকে আপনি উপদেশ দিচ্ছেন শত্রুর বুকে পাথর না ছুড়ে, তার গুলিকে বুকে পেতে নিতে??

    মাশাআল্লাহ, অসাধারণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *