কুরবানি, মুশফিকুর রহিম এবং অন্যান্য

১.

সাধারণত পশু কুরবানির দৃশ্য ধারণ করে তা সোশ্যাল নেটওয়ার্কে দেওয়াতে ব্যক্তিগতভাবে আমার আপত্তি আছে। আপত্তি বলতে আমি নিজের জন্যে তা জরুরি মনে করি না এবং দিইও না। আমার ঈমানের কমজুরি, ইখলাসের ঘাটতি এবং ভরপুর তাকওয়ার অভাবে এ-সমস্ত ছবি ফেইসবুকের মতোন প্ল্যাটফর্মে দিতে দ্বিধাবোধ করি। তবে, সাথে আমি এও বিশ্বাস করি, যাদের ঈমানের জোর অনেক, যাদের ইখলাস কিংবা তাকওয়া নিয়ে সন্দিহান হওয়ার শঙ্কা নেই, তারা নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে তা এখানে দিতে পারেন।

২.

পশু কুরবানির সংস্কৃতিটা আমরা আমাদের পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম হতে লাভ করেছি। তবে, পশু হিশেবে গরু কুরবানি নিয়ে আমাদের, উপমহাদেশের মুসলিমদের আলাদা একটা ত্যাগ এবং সংগ্রামের গল্প আছে। পিতা বুরহানউদ্দীন যখন তার শিশুপুত্রের আকিকার জন্যে গরু কুরবানি করেছিলেন একদা, তখন নিপীড়ক রাজা গৌর-গোবিন্দ গরু জবাইয়ের কারণে তার শিশুপুত্রকে হত্যা করে। পরে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের নির্দেশে হজরত শাহ জালাল রাহিমাহুল্লাহ প্রমুখগন অত্যাচারী গৌর-গোবিন্দকে পরাজিত করে আমাদেরকে গরু কুরবানির অধিকার ফিরিয়ে দেন। এই সংগ্রাম আমাদের টিকে থাকার, বেঁচে থাকার সংগ্রাম। অধিকার ফিরে পাবার এবং নীপিড়কের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার সংগ্রাম ছিলো সেটা। আমরা আমাদের গরু কুরবানির সংস্কৃতি থেকে এই সংগ্রামের মাহাত্ম্যকে মুছে দিতে পারি না।

তবে, গৌর-গোবিন্দরা অতীত হলেও তাদের রক্তধারা এখনও বহমান। এখনও গরু কুরবানির কারণে, গরু জবাইয়ের কারণে, গরুর গোশত খাওয়ার কারণে এবং ফ্রিজে গরুর গোশত আছে সন্দেহে লাশ হয়ে যেতে হয় আরো অসংখ্য বুরহানউদ্দীনের পুত্রদের। গৌর-গোবিন্দদের রাজনীতি এবং বিদ্বেষ যেহেতু এখনও দৃশ্যমান, তাই অধিকার ফিরিয়ে আনার কিংবা অধিকারের বয়ানে অটুট থাকার একটা প্রতিবাদী সংস্কৃতি হয়ে উঠতে পারে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে গরু জবাইয়ের ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা। সুতরাং, আমি এটাকে সমর্থন করি। গরু জবাইয়ের ছবিতে ভরে উঠুক ফেবু-পাড়া।

৩.

মুশফিকুর রহিম প্রতি-বছর কুরবানির ঈদে পশু জবাই পরবর্তী ছবি ফেইসবুকে দেয় এবং তা নিয়ে একটা মহলে ভালো রকমের বিতর্ক ছড়ায়। যদিও মহলটা ইনিয়ে বিনিয়ে ‘এমন ছবি কেনো দেওয়া উচিত নয়’ ধরণের নানান বক্তব্য হাজির করে মুশফিকের পিন্ডি চটকায়, কিন্তু আমরা তো জানি— তারা আদতে বহু শতাব্দী প্রাচীন গৌর-গোবিন্দদের রাজনীতিকে নতুনরূপে তুলে আনতে বদ্ধপরিকর। মডার্ণ গৌর-গোবিন্দদের এহেন সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করেও বারংবার মুশফিকের এমন সাহসী পদক্ষেপ সত্যিই ভালো লাগার। মুশফিকের জন্যে ভালোবাসা।

৪.

‘পশু জবাইয়ের ছবি দেখলে বাচ্চারা ভয় পাবে, দূর্বল চিত্তের মানুষেরা বেহুশ হয়ে পড়বে’ ধরণের বকওয়াসগুলো প্রতিবছর ঘুরেফিরে চলতে থাকে। তাদের কে বোঝাবে যে—বাচ্চারা ফেইসবুক চালায় না? আর যারা চালায় তারা আদৌ বাচ্চা না? আমার আশপাশের বাচ্চাদের আমি যে আগ্রহ আর আনন্দের সাথে পশু কুরবানির দৃশ্য উপভোগ করতে দেখি তা অতুলনীয়। আমাদের বাচ্চাদেরকে জীবন আর মৃত্যুর মেলবন্ধন শেখাতে, ত্যাগ আর সংযমের দীক্ষা দিতে কুরবানির চাইতে উত্তম উপলক্ষ আর কিছু নেই। তারা কেবল রক্তধারা দেখবে না, সাথে দেখবে রবের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসার আবেগ। তারা পরিচিত হবে এমন এক সিলসিলার সাথে যে সিলসিলা ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের মাধ্যমে এই ধরাকে করে তুলেছিলো প্রাণবন্ত, প্রাণোচ্ছল। কাজী নজরুলের ভাষায়— ‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্ভোধন’।

আমাদের প্রগতিবাদীরা বলতে চান— যারা পশু জবাইয়ের সাথে যুক্ত, তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নাকি ততোধিক। ঘটনা সত্য হলে সরকারের উচিত আজকেই হাসপাতালগুলোর ফরেনসিক ইউনিটগুলো বন্ধ করে দেওয়া। যেসব ডাক্তারেরা লাশের পোস্টমর্টেম করে, তারা যে কতো ভয়াবহ রকমের সন্ত্রাসী হয়ে আছে, তা ভাবতে গেলেই তো গা শিউরে উঠার কথা! কিন্তু বাংলার প্রগতিশীল গোষ্ঠী তা মানবেন না। তারা শুধু মুসলমানদের কোরবানি নিয়েই প্রশ্ন তুলবেন।

৫.

কুরবানির সময়টায় এদেশে বেশ কয়েকবছর ধরে বন্যা হচ্ছে। তো, প্রগতিশীল বাঙালিরা মুফতির বেশ ধরে আজকাল বলতে চান, ‘কুরবানি তো অনেক দিলেন, এবারের কুরবানির গরু না কিনে, ওই টাকা দুঃস্থদের দান করে দেন, উপকার হবে’।

এসব প্রগতিবাদীরা জানে না, ইসলাম দান সাদাকার ব্যাপারে এতো বেশি উৎসাহ দেয় যে, প্রগতিশীলদের কোন বাড়তি উৎসাহ মুসলমানদের দরকার নেই। সাদাকার জন্যে নিজের চুলোর ছাই নিয়ে আসার ঘটনা থেকে শুরু করে নিজেদের একাধিক স্ত্রী থেকে একজনকে তালাক দিয়ে অপর ভাইয়ের সাথে তার বিবাহের বন্দোবস্ত করার ঘটনাও ইসলামে আছে যা আমরা মদীনায় মুসলিমদের হিজরতের ঘটনায় দেখতে পাই। নবিজী সাদাকার কথা বললে মহিলারা তৎক্ষণাৎ নিজেদের গহনাগাঁটি খুলে দিয়ে দেওয়ার ঘটনাও অজানা নয় ইসলামে।

খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অনেক আগ থেকেই এসব বন্যা কবলিত এলাকায় মুসলমানেরা তাদের যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে কোন মাইকিং ছাড়াই। কিন্তু মুসলমানেরা ঢোল পিটিয়ে দান সাদাকা করে না বলেই হয়তো আমাদের প্রগতিশীলেরা সেই খবর জানতে পারে না। সারাবছর নামী দামী রেস্টুরেন্টগুলোয় খেয়ে, খাবার অপচয় করে, পহেলা বৈশাখে নিজেদের উদরপূর্তি উৎসব সেরে কুরবানি এলেই কেবল তারা কুরবানি না করে সেই টাকা সাদাকা করার বয়ান হাজির করেন। এইসমস্ত সেক্যু-মুফতির কাছে নিজের ঈমান বেচে দিবেন না যেন।

আরিফ আজাদ
আরিফ আজাদ

আরিফ আজাদ একজন লেখক এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। ২০১৭ সালে 'প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ' বইয়ের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। লিখেন বিশ্বাসের কথা, চূর্ণ করেন অবিশ্বাসের আয়না। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ঘুরতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন।

Articles: 46

15 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *