কুরআনের শব্দবন্ধনীগুলো নিয়ে আমার দুর্নিবার আগ্রহ। তিলাওয়াতের সময় অথবা তিলাওয়াত শ্রবণের সময় আমি খুব সচেতনতার সাথে খেয়াল করি কোন শব্দের পর কোন শব্দ আসছে। শব্দের অর্থগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। নির্ভরযোগ্য তাফসিরগুলো থেকে ব্যাখ্যাগুলো দেখে দেখে, শব্দমূলগুলো জেনে জেনে আগানোর চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে এত চমৎকৃত হই—সুবহানাল্লাহ!

সুরা মুলক তো জীবনে কতোবার পড়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। প্রতি রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে এই সুরা তিলাওয়াতের জন্য বলেছেন প্রিয় রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সুরাটা এমনিতেই আমার ভীষণ প্রিয়, তারউপর এর শব্দবিন্যাসের বৈচিত্রতা যেন তিলাওয়াতে অন্যরকম আবহ তৈরি করে। এক নৈসর্গিক দ্যোতনা যেন কাঁপিয়ে দিয়ে যায় অন্তর।

সেদিন সুরা মুলক তিলাওয়াত করতে গিয়ে দ্বিতীয় আয়াতটায় এসে থমকে গেলাম। ‘আল্লাযী খ্বলাক্বাল মাওতা ওয়াল হায়াতা লিআবলুয়াকুম আইয়্যুকুম আহসানু আমালা—ওয়াহুয়াল আযীযুল গফুর’।

কেন এই আয়াতে এসে থমকে গেলাম সেই বিষয়টায় যাওয়ার আগে বলে রাখি, সুযোগ পেলেই আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার গুণবাচক নামসমূহ তথা আসমাউল হুসনা নিয়ে পড়াশুনাতে ডুব দিই। আল্লাহকে গভীরভাবে জানতে হলে, আল্লাহর নামগুলো জানার কোনোই বিকল্প নেই। প্রতিটা নামের যত গভীর থেকে গভীরে যাই, আমার কপাল যেন ততই সিজদাহবনত হয়ে পড়ে। সুবহানাল্লাহ—কী অসাধারণ আল্লাহর নামগুলো!

একটা মানুষের জীবনে যা কিছু প্রশ্ন, যা কিছু জিজ্ঞাসা, যা কিছু সমস্যা, আনন্দ-বেদনা-হতাশা—সবটার যেন সচিত্র উত্তর এই নামগুলোর মাঝে খোদাই করা আছে। বিশ্ব সংসারের যত অমীমাংসীত রহস্য, তার সবটার জট যেন এই নামগুলোতে এসে ছিঁড়ে যাওয়া তসবিহ দানার মতো ঝরঝর করে ছড়িয়ে পড়ছে। সে এক বিস্ময়কর জ্ঞানের দুনিয়া!

সুরা মুলকের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন, ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন—যাতে তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন আমলের দিক থেকে কে তোমাদের মধ্যে উত্তম। আর, তিনি (একদিকে যেমন) মহাপরাক্রমশালী, (আবার অন্যদিকে) অতিশয় ক্ষমাশীল’।

এই আয়াতে এসে আমার থমকে যাওয়ার মূল কারণটা হলো আয়াতের শেষে ব্যবহৃত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নাম দুটো—আল আযীয, আল গফুর। মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল।

কুরআনের প্রত্যেকটা বর্ণ, প্রত্যেকটা শব্দ বিপুল অর্থ বহন করে। প্রতিটা বর্ণের পর বর্ণ, প্রতিটা শব্দের পর শব্দ, প্রতিটা আয়াতের পর আয়াত, প্রতিটা সুরার পর সুরা—এমনভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সাজিয়েছেন যে—সবখানেই তিনি উপদেশগ্রহণকারীদের জন্য ছড়িয়ে রেখেছেন জ্ঞানের মুক্তোমালা। ভাবুক হৃদয়, চিন্তক মন আর অনুসন্ধিৎসু চোখজোড়া সেসব দেখে আর জেনে বিস্ময়াবিভূত হয়। বিগলিত হয় তার হৃদয়।

কুরআনে একটা যতিচিহ্নও এমন নেই যা খামখেয়ালিপূর্ণ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যখন ‘আর রাহমান’ এবং ‘আর রাহীম’ একসাথে বলেন, নিশ্চয় সেটার রয়েছে নিগুঢ় কোনো কার্যকারণ। তিনি যখন ‘আল আযীয’ এবং ‘আল হাকিম’ একসাথে উচ্চারণ করেন, অতি অবশ্যই সেটার রয়েছে কোনো প্রেক্ষাপট।

কুরআন কবিতা নয় যেখানে থাকে নিছক খামখেয়ালিপূর্ণ ছন্দ আর বাক্যবিন্যাসের পসরা। কুরআন হলো আল্লাহর কথা—প্রত্যেকটা বর্ণই এখানে সুচিন্তিতভাবে সাজানো। প্রত্যেকটা যতিচিহ্নই এখানে জীবন্ত।

সুরা মুলকের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলছেন—তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু আর জীবন। কেন সৃষ্টি করেছেন? ভেঙেই উত্তর দিচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা—যেন তিনি আমাদের পরীক্ষা করতে পারেন যে, আমল করার ব্যাপারে আমাদের মাঝে কারা উত্তম।

এতটুকুতেই চাইলে আয়াতটা শেষ হতে পারত। আয়াতের যা কিছু মূল নির্যাস—সবটাই এখানে খুব সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মৃত্যু আর জীবনকে এজন্যেই সৃষ্টি করেছেন, যাতে তিনি পরীক্ষা করতে পারেন আমাদের মাঝে কারা আমলের দিক থেকে উত্তম।

কিন্তু, মহান রব আয়াতটা সেখানে সমাপ্ত করেননি। আয়াতটির শেষে তিনি নিজের দুটো গুণবাচক নাম ব্যবহার করেছনে—ওয়াহুয়াল আযীযুল গফুর। তিনি মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল।

অর্থগত দিক থেকে আল্লাহর ‘আল আযীয’ নামটা খুবই চমৎকার। নামটার রয়েছে কয়েকটা অর্থ, যেমন—মহাপরাক্রমশালী, মহা-সম্মানিত, সর্বশক্তিমান।

‘আল আযীয’ বলতে এমন কাউকে বোঝায় যিনি সমস্তকিছুর নিয়ন্ত্রণ করেন নিজের শক্তি দ্বারা। যাকে হারানো যায় না, পরাজিত করা যায় না। তিনি যা ইচ্ছা করতে পারেন, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে গড়তে বা ভাঙতে পারেন।

আবার, আল্লাহর ‘আল গফুর’ নামটাও অত্যন্ত অর্থবহুল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যে বান্দার প্রতি কল্পনাতীত দয়ালু—এই ব্যাপারটাই আল্লাহর ‘আল গফুর’ নামের মাঝে পরিস্ফুট হয়ে উঠে। তিনি এমনভাবে বান্দাকে ক্ষমা করেন যে—সেটা বিস্ময়কর!

সুরা মুলকের দ্বিতীয় আয়াত, যেখানে আল্লাহ বলছেন তিনি মৃত্যু আর জীবনকে সৃষ্টি করেছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য যে—আমলের দিক থেকে কে কার চেয়ে উত্তম’। এই অংশটার সাথে নিজের দুটো গুণবাচক নাম ‘আল আযীয’ এবং ‘আল গফুর’ জুড়ে দেওয়ার রহস্যটা কী তাহলে?

এই আয়াতটা মূলত আখিরাতের জীবনকে চিত্রিত করে আমাদের সামনে। কারণ ‘উত্তম আমলের পরীক্ষার’ যে ফলাফল, সেই ফলাফল আমরা দুনিয়াতে পাব না। সেই ফলাফল দেখতে পাব আখিরাতে। এই পরীক্ষায় কে জিতল, কে হারল, কে ফার্স্ট ক্লাস পাবে আর কে পাবে থার্ড গ্রেড—এইসব খোলাসা করা হবে কিয়ামতের মাঠে।

যেহেতু আয়াতটা আখিরাত-কেন্দ্রিক, আরও বিশেষভাবে বললে কিয়ামত দিবস-কেন্দ্রিক, সেহেতু আয়াতের সাথে জুড়ে থাকা আল্লাহর ‘আল আযীয’ এবং ‘আল গফুর’ নাম দুটোকেও আমাদেরকে সেভাবে মিলিয়ে পড়তে হবে।

চলুন তাহলে, নাম দুটোকে আয়াতের সাথে আমরা একবার মিলিয়ে পড়ি। পড়তে যাওয়ার আগে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ‘আল আযীয’ এবং ‘আল গফুর’ নামের অর্থ দুটো আরও একবার পরখ করে নিই।

আল আযীয—যিনি মহাপরাক্রমশালী। যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন।

আল গফুর—যিনি অতিশয় দয়ালু। বিস্ময়করভাবে তিনি বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।

এবার আয়াতটাকে মিলিয়ে পড়ি—

‘তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন—যাতে তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন আমলের দিক থেকে কে তোমাদের মধ্যে উত্তম। তিনি এতো পরাক্রমশালী যে—তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের প্রত্যেককে সেদিন আটকাতে পারবেন। সেই ক্ষমতা তিনি রাখেন। যদি তিনি তা করতে চান, তাহলে কেউ নেই তাকে আটকাতে পারবে। কেউ নেই তাকে প্রশ্ন করতে পারবে। তবে, এটাও জেনে রাখো—তিনি শুধু মহাপরাক্রমশালীই নন, একইসাথে তিনি অতিশয় দয়ালুও’।

কিয়ামত দিবস-কেন্দ্রিক একটা আয়াতের শেষে ‘আল আযীয’ নামটা নেহায়েত ছন্দগত মিল থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ব্যবহার করেননি। সেই দিনের সত্যিকার রাজত্ব হবে কেবলই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার। মুলক শব্দের অর্থই হলো—রাজত্ব। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন, সেদিন তিনি আমাকে, আপনাকে, আমাদের সকলকে আটকে দিতে পারবেন। এমন ভাববেন না যে, তিনি অন্যায়ভাবে, স্বেচ্ছাচারিতা করে আমাদের আটকাবেন। এটা আল্লাহর শান আর শওকতের পরিপন্থী।

আটকানোর জন্য আমাদের জীবন থেকে অসংখ্য ভুল, অসংখ্য গুনাহ, অসংখ্য অবাধ্যতা তিনি বের করে আনতে পারবেন। নবি আর রাসুলগণ ছাড়া, আমাদের আর কার জীবন ফুলের মতো স্বচ্ছ, কোমল আর পবিত্র? আমাদের কার জীবনে পাপ নেই, গুনাহ নেই, সীমালঙ্গন নেই? একটা আস্ত দিন তো বহুদূর, কেবল একটা ঘণ্টার খতিয়ান যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করতে যান, ভাবুন তো আমরা ক’জন সেদিন উতরে যেতে পারব?

এটাই আল্লাহর ক্ষমতা। তিনি তো কোনোকিছুই ভুলে যান না। তিনি ইচ্ছা করলে কিয়ামতের ময়দানে আমাদের প্রত্যেককে দোষী সাব্যস্ত করে, জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলতে পারবেন।

আয়াতটার সাথে ‘আল আযীয’ নামটা রেখে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের বলছেন যে—‘ভুলে যে-ও না আল্লাহ অসীম ক্ষমতাধর। তিনি যদি আটকাতে চান তাহলে তোমাকে আটকানো তাঁর জন্য নিতান্তই সোজা। তোমার পাপের ব্যাপারে উদাসীন হয়ো না। খেয়াল রেখো—আল্লাহ কিন্তু কোনোকিছুই ভুলে যান না। তোমার আমল নিয়ে উল্লসিত হয়ো না, অহংকার করো না। সেসবকে ধুলোধূসরিত করে দেওয়া তাঁর জন্য খুবই সহজ।

এই সতর্কবার্তা প্রদানের পর ‘আল গফুর’ নামটা উল্লেখ করে আল্লাহ বলছেন—‘এটাও খেয়ালে রেখো—তোমার রব অতিশয় দয়ালু। তুমি যদি ক্বলবুন সালীম তথা একটা পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে তাঁর সামনে হাজির হতে পারো, হতে পারে তোমার গুনাহ সমুদ্রের জলরাশি পরিমাণ, হতে পারে তোমার পাপ আকাশ ছুঁয়েছে, হতে পারে তোমার আমল এতো নগন্য যে আঙুল দিয়ে গোনা যায়—তবু তিনি চাইলে তোমাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।

নবিজি সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস থেকেও আমরা জানতে পারি, তিনি বলেছেন— ‘আল্লাহর ক্ষমা তাঁর ক্রোধের উপর বিজয়ী হয়’।

এই আয়াতে ‘আল আযীয’ নামটা ব্যবহার করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর শক্তিমত্তার বিষয়টাই উল্লেখ করেছেন। তারপর ‘আল গফুর’ নামটা দিয়ে জানান দিয়েছেন তাঁর চিরাচরিত ক্ষমাশীলতার।

সুরা মুলকের এই আয়াত থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ‘আল আযীয’ নামটা আমাদের হৃদয়ে কাঁপন ধরাক। যেন আমরা গুনাহের ব্যাপারে, আল্লাহর অবাধ্যতার ব্যাপারে, সীমালঙ্গনের ব্যাপারে উন্মত্ত না হয়ে পড়ি।

একইসাথে, আল্লাহর ‘আল গফুর’ নামটা আমাদেরকে সেই হতাশা থেকে টেনে তুলুক—যে হতাশা আমাদেরকে তাওবার দরোজার দিকে দৌঁড়ে যেতে বাঁধা দেয়। অনুতপ্ত হৃদয়, অশ্রুসিক্ত চোখ আর প্রকম্পিত অন্তর নিয়ে তাঁর কাছে ছুটে যাওয়ার জন্য যে ধাক্কাটা দরকার, তার সবটাই যেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা খোদাই করে রেখেছেন এই ‘আল গফুর’ নামের মাঝে।

আরিফ আজাদ
আরিফ আজাদ

আরিফ আজাদ একজন লেখক এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। ২০১৭ সালে 'প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ' বইয়ের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। লিখেন বিশ্বাসের কথা, চূর্ণ করেন অবিশ্বাসের আয়না। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ঘুরতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন।

Articles: 47

15 Comments

  1. মাশাল্লাহ, আল্লাহ আপনাকে ও আমাদের কে কোরাআন শরিফ আরো গভিরভাবে অনুধাবন করার ও আমল করার তৌফিক দান করোন। আমিন।

  2. আলহামদুলিল্লাহ খুব সুন্দর উপস্থাপনা ভাই আমার। আল্লাহ পাক মুসলিম উম্মাহকে কবুল করুক। আমিন ।

  3. জাযাকাল্লাহ , বারাকাল্লাহু ফি হাইয়াতি

  4. সুবহানাল্লাহ।
    আমি জানি না কি বলবো তবে এই লেখাগুলো পড়ে আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেছে ।

  5. অসাধারণ লেখনি।
    আমরা ক’জনই বা এরকম গভীরভাবে কোরআনের অর্থ গুলো পড়তে গিয়ে চিন্তা করি।
    করি না তো। সত্যি এভাবে গভীরভাবে ভেবে পড়তে গেলে আমাদের হৃদয় যেমন প্রশান্তি লাভ করবে তেমনি আত্মিক কানেকশন বাড়তেই থাকবে বাড়তেই থাকবে মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে।

    আরিফ আজাদ স্যার আমি আপনার ভক্ত। ইনশাআল্লাহ জীবনে কোন একদিন আপনার সাথে মুলাকাত করতে চাই আল্লাহ যেন আমাকে সেই তৌফিক দান করেন । ইনশাআল্লাহ

Leave a Reply to আয়শা সিদ্দিকাCancel Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *