একই মৃত্যু— অথচ কী ভিন্ন তার রেখাপাত!

[১]

বাংলা ভাষার বেশকিছু শব্দের জঘন্য রকমের বিকৃতি ঘটেছে। সেরকম দুটো শব্দ হলো— দালাল এবং ঘটক। কোনো একটা কাজে যে বা যিনি মধ্যস্থতা করে থাকেন তাকেই দালাল বলা হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্য শব্দটার! দালালের অর্থ এখন হয়ে গেছে চাটুকারিতা, তোষামেদি, পদলেহন ইত্যাদি। অর্থাৎ,  নিজের স্বার্থ বজায় রাখতে বা টিকিয়ে রাখতে যে অন্যের চাটুকারিতা করে বেড়ায় তাকে আমরা দালাল বলি। কী সুন্দর একটা শব্দের কী এক জঘন্য পরিণতি!

এরকম আরেকটি শোচনীয় পরিণতি বরণ করেছে ‘ঘটক’ শব্দটি। অবশ্য, দালাল শব্দের মতোন অতোটা পোড়াকপাল তার নয়। ঘটক সেই ব্যক্তি যিনি একটা বিয়েতে বরপক্ষ এবং কনেপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। খুবই ভালো এবং নামদার একটা পেশা বটে!  অথচ, অদৃশ্যমান হলেও শব্দটার সাথে জড়িয়ে গেছে কিছু অপ্রিয় ব্যাপার-স্যাপার।

কিছু কদর্য ব্যক্তির বাড়াবাড়ি রকম আচরণে ঘটক শব্দ শুনলেই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে এমন এক চরিত্র, যিনি বেশি কথা বলেন, যিনি যা বলে থাকেন তার অধিকাংশই মিথ্যা, যিনি সবসময় বাড়িয়ে বলেন এবং দিনশেষে এসবের পেছনে তার রয়েছে একটা মোটা স্বার্থ৷ স্বার্থটা কী? সেটা হলো— কোনোমতে বিয়েটা ঘটিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে! একটা হাজার টাকার ব্যবসা! এই দুটো শব্দের এহেন জঘন্য পরিণতির জন্য শেষপর্যন্ত যে জীবটি দায়ী তার নাম মানুষ!

সম্প্রতি একটা ‘সফল ঘটকালি’ সম্পন্ন করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, আলহামদুলিল্লাহ।  কনে আমার স্ত্রীর বান্ধবি আর বর আমার বন্ধু মানুষ। দুজনের মধ্যে মেলবন্ধনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাকে মধ্যস্থতাকারী বানিয়েছেন। তাই, প্রসঙ্গক্রমে যখনই কেউ পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘উনিই হচ্ছেন এই বিয়ের ঘটক’, তখন ভারি লজ্জা লাগে। মন উসখুস করে। কী একটা বিশ্রী কান্ড! ভাবি— আমিই ঘটক এই কথা শোনার পর মানুষগুলো আমার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে? ভাবছে আমি একটা মিথ্যের জাহাজ? ভারি ভারি মিথ্যে কথা আর সাত-পাঁচ বুঝিয়ে দু’পক্ষের মাথা খেয়েছি? টাকার লোভে তাদের আমি আকাশ-পাতাল বুঝিয়েছি? লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়!

ইচ্ছে করে বাংলা অভিধান থেকে ‘ঘটক’ শব্দটাকেই ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিই। কিন্তু, ও কাজ তো আমার দ্বারা সম্ভব না। আমি তো বাংলা ভাষার হর্তাকর্তাদের কেউ নই। আমি যা পারি তা হলো এই শখের ঘটকালি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। তাই ইচ্ছে।

[২]


শখের ঘটকালি করে ফেললাম, অথচ চূড়ান্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবো না, তা বোধকরি ভালো ঠেকে না। একে তো বর আমার বন্ধু মানুষ, কনে আমার প্রিয়তমার প্রিয়তম বান্ধবি। তার উপরে আমিই ঘটক। এমন ত্রিশৈল চক্রে বাঁধা পড়ে বিবাহ অনুষ্ঠানে আমাকে আসতেই হলো। ইট-পাথর আর দূষিত বাতাসের শহর ঢাকা ছেড়ে নির্ঝঞ্ঝাট, সবুজ-শ্যামলিমা আর ছায়াঢাকা কুষ্টিয়ার পথে বিয়ের বর সমেৎ রওনা করতে হলো ট্রেনে। ঢাকা টু খুলনার ট্রেন। আমরা নেমে যাবো ভেড়ামারা ষ্টেশানে। পথিমধ্যে অতিক্রম করতে হলো সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ষ্টেশান। ওই ষ্টেশানে আমাদের ট্রেন থামতেই আমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ করে চ্যাঁৎ করে উঠলো।

নাহ, এই ষ্টেশান ঘিরে আমার কোন সুখস্মৃতি নেই, তবে শোকস্মৃতি আছে। এই তো কয়েকদিন আগের ঘটনা। সপ্তাহও তো হলো না৷ এই এলাকাতেই কী করুণ একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেলো! মাইক্রো করে বরসহ বরযাত্রী যাচ্ছিলো। ট্রেনের সাথে ধাক্কা লেগে মূহুর্তে ঝরে গেলো কতোগুলো প্রাণ! মারা গেলো বিয়ের বরটাও। আহারে! স্বপ্ন শুরুর আগেই স্বপ্নভঙ্গ!  সূর্যোদয়ের আগেই যেন জীবনে নেমে এলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত সূর্যাস্ত। মৃত্যু কতো সহজ! কতো নিকট!

ভাবছিলাম— আমিও তো বরযাত্রী যাচ্ছি। আমার সাথেও তো এক বর বসে আছে। তার চোখেমুখে স্বপ্নের মাখামাখি। তিনি ভাসছেন এক স্বপ্নের নদীতে। সেই নদীতে ছলাৎ ছলাৎ করে উপচে পড়ছে সুখের ঢেউ। সেই ঢেউয়ে ভারি উথলা তার মন। ঢেউয়ের পরতে পরতে স্বপ্নের গাঁথুনি। বাতাসে সুখের ঝনঝনানি।


আচ্ছা, যদি আজ আমাদের সাথেও ঘটে যায় সেদিনকার মতোন কোন ঘটনা? যদি কোন দূর্ঘটনায় স্বপ্নভঙ্গ হয় সকলের? যদি শোনা যায় বগিচ্যুত হয়ে পড়েছে আমাদের ট্রেন? যদি চিৎকার-চেঁচামেচিতে আজও ভরে উঠে উল্লাপাড়ার আকাশ? যদি মৃত্যু হয় বরের? যদি মৃত্যু হয় আমার? হতেও তো পারে! এই জগত সংসারের কোনটাই তো মানুষের ইচ্ছের দামে হয় না। যিনি এই জগত সংসারের মালিক, তার ইচ্ছেই তো সব, তাহলে?

আমি কি প্রস্তুত আছি মৃত্যুর জন্যে? সেদিনকার ওই বর কি প্রস্তুত ছিলো? আত্মভোলা এই দেহের উপর যদি মৃত্যু এসে ভর করে? তাহলে কি হবে? নিতান্তই অপ্রস্তুত হয়ে ঢুকে পড়বো এক মহা সমাবেশে? কীসের উপর আমার মৃত্যু হচ্ছে? হাসি-কৌতুক আর ঠাট্টা-তামাশার উপর? গান-বাজনা আর নাফরমানির উপর? অকৃতজ্ঞতা-অবাধ্যতার উপর? সে এক মহাভাবনা!

[৩]

মারা গেছেন হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ। তিনি মারা যাওয়ার সাথে সাথে একটা জিনিস চাউর হয়েছে। গুলশান মদের বারে তার মৃত্যু শোকে আধ ঘন্টার জন্য মদ পান বন্ধ রাখা হয়েছে। হায় কপাল! কী এক মৃত্যু আর তার প্রতি কী এক নিবেদন!

কুষ্টিয়া এসে জানলাম এখান থেকে ঝিনাইদহ একেবারে কাছে। এতো কাছে এলাম, অথচ স্যার খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহর স্মৃতি বিজড়িত আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট দেখবোনা, তা কী করে হয়? এমন সুযোগ হাতছাড়া করি কোন দুঃখে?


বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেই রওনা করলাম ঝিনাইদহ আস-সুন্নাহ ট্রাস্টে। আমার স্যারের নিজের হাতে গড়া ইমারত! আহা, সেই দেওয়াল, সেই মাদ্রাসা, সেই টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো! সবকিছুই ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু নেই সেই মানুষটা! তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম খানিকক্ষণ।  ভাবলাম— শতধা বিভক্ত এই উম্মতকে এক করতে চাওয়া মানুষটা যদি দেখতেন এই উম্মত আরো সহস্র, অযুত-নিযুত দলে ভাগ হয়ে গেছে, তিনি কি আপসোসটাই না করতেন!

এরশাদের মৃত্যুর সংবাদে মদের বারে আধ ঘন্টার জন্য মদ পান বন্ধ ছিলো। আর, স্যার খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের মৃত্যুর সংবাদ শুনে ভগ্ন হৃদয়ে তার জন্য দোয়া করেনি, হাত তুলে তার মাগফিরাত কামনা করেনি, তাহাজ্জুদে তার নাযাত কামনা করেনি এমন দরদী মুসলমান এই তল্লাটে বিরল হবে। দুটোই মৃত্যু— অথচ মানবহৃদয়ে কী ভিন্ন তার রেখাপাত! 

আরিফ আজাদ
আরিফ আজাদ

আরিফ আজাদ একজন লেখক এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। ২০১৭ সালে 'প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ' বইয়ের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। লিখেন বিশ্বাসের কথা, চূর্ণ করেন অবিশ্বাসের আয়না। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ঘুরতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন।

Articles: 46

81 Comments

  1. ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করলে অনেক ভালো হতো।।
    জাঝাকাল্লাহু খাইরান

  2. প্রশ্ন,

    দাওয়াত দিতে গিয়ে এক ভাই প্রশ্ন করল,
    কোরআনে যে বিজ্ঞান সম্পর্কে কথা গুলো বলা আছে তা
    আমরা বাংলা পড়ে বুঝতে পারি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বঙ্গানুবাদ কোনোভাবে বিজ্ঞানের আলোকে তৈরি করা নাতো? এটা আমার মনেও ছোট প্রশ্ন তৈরি করলো। কারণ, অনেক জায়গায় দেখা যাই মানুষ ওই লাইন গুলো যেভাবে বলে বাংলা বা ইংরেজি অনুবাদ করা কোরআনে বা গুগল ট্রানস্লিশনে অনেক সময় ওই রকমটা পাওয়া যায় নাহ। (আমি সাজিদ ১ ও ২ পড়েছি।)

    প্রিয় ভাই, আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকব।????????

  3. অনেক দোয়া ও অভিরাম ভালোবাসা রইল আপনার জন্য প্রিয় ভাই।♥

  4. কিছু মানুষের প্রতি আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে ভালবাসা সৃষ্টি করে দেয়। তাদের কথা স্মরণ শুধু মন থেকে দোয়া আসে।
    খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ ওনার কথা মনে এসে বুকের ভেতরে এক ফাঁকা অনুভব করলাম।

  5. মা শা আল্লাহ গল্পের মাঝেই কতগুলো রিমাইন্ডার দেওয়া আছে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের কে বুঝার ও মানার তৌফিক দান করুন

  6. আল্লাহ তায়ালা আপনার কলমে ✒ বরকত দান করুন। আপনার আর্টিকেলগুলো শুধু পড়তেই মন চায়। সারাদিন পড়লেও এতটুকুন বিরক্তি আসে না। পড়া শুরু করে শেষ হওয়ার পূর্বেই পড়া বাদ দিবে এমন মানুষ বোধকরি খুজে পাওয়া দুষ্কর।????

  7. আল্লাহর জন্যই আপনাকে ভালো বাসি…????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????????

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *