আপনার জীবনে যদি কোন ইউসুফ আসে

ইউসুফ যেহেতু তাদের পথের কাঁটা, তাই তাঁকে যেকোনমূল্যে পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছালে তাঁর ভাইয়েরা।

খেলার নাম করে নিয়ে গিয়ে তারা বালক ইউসুফ আলাইহিস সালামকে একটা কূপের মধ্যে ফেলে দিলো। যদিও ইউসুফকে প্রাণে হত্যা করবার সিদ্ধান্ত থেকে তারা শেষ অবধি সরে এসেছে, তারা চেয়েছে— ইউসুফকে কোন অপরিচিত কাফেলা এতোদূরে নিয়ে যাক যেখান থেকে ইউসুফ আর কোনোদিন পিতার কাছে ফিরতে পারবে না। পিতাও কোনোদিন নাগাল পাবে না ইউসুফের।

ভাইদের স্বপ্ন-ই পূরণ হলো। ইউসুফকে কূপে নিক্ষেপের খানিক বাদে বহুদূরগামী একটা কাফেলা সেখানে এসে থামলো এবং ওই কূপ থেকে পানি সংগ্রহের জন্য তাদের একজনকে নিযুক্ত করলো। লোকটা পানি আনতে গিয়ে দেখে কূপের মধ্যে একটা ফুটফুটে বালক সাঁতরে বেড়াচ্ছে আর উপরে উঠে আসার জন্যে হাপিত্যেশ করছে। ইউসুফ আলাইহিস সালামকে দেখে লোকটা মহাখুশি হলো। বললো, ‘বাহ, কী দারুন ব্যাপার! এ-যে দেখছি একেবারে অপ্রত্যাশিত জিনিস!’

লোকটা কূপ থেকে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে তুলে আনলো। ওদিকে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে ইউসুফ আলাইহিস সালামের ভাইয়েরা দেখতে লাগলো যে ঘটনা আসলে কোনদিকে মোড় নেয়। যে-ই ইউসুফ আলাইহিস সালামকে কূপ থেকে তুলে আনা হলো, অমনি তারা দৌঁড়ে কাফেলাটার কাছে এসে বললো, ‘শুনুন, এ ছিলো আমাদের একজন কৃতদাস। কাজে ফাঁকি দিয়ে আজ সে পালাতে চেয়েছিলো। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস দেখুন, শেষমেশ কূপে পড়ে গিয়ে সে তো মরতেই বসেছিলো। যাহোও, ও-কে আমরা আর ফেরত চাই না। আপনারা বরং তাকে কিনে নিয়ে যান’।

যেহেতু ভাইয়েরা ইউসুফ আলাইহিস সালামকে ‘কৃতদাস’ হিশেবে পরিচয় দিয়েছিলো এবং তাঁকে বিক্রিও করে দিতে চায়, সুতরাং কাফেলাটা বেশ স্বল্পদামে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে কিনে নিয়ে নেয় ভাইদের কাছ থেকে।

বলাই বাহুল্য, ইউসুফ আলাইহিস সালামের ভাইদের উদ্দেশ্য এটা ছিলো না যে— তারা তাঁকে বিক্রি করে দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেবে। তাদের একটাই উদ্দেশ্য— যেকোনমূল্যে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া। কিন্তু কাফেলার কাছে তো আর সে কথা বলা যায় না, তাই তারা ইউসুফকে কৃতদাস পরিচয় দিয়ে একেবারে নামমাত্র মূল্যে কাফেলাটার কাছে বিক্রি করে দিলো।

কুরআন ব্যাপারটাকে বর্ণনা করেছে এভাবে—

‘তারা তাকে একেবারে স্বল্প মূল্যে— মাত্র কয়েকটি দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল। মূলত ইউসুফের (মর্যাদার) ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞানই ছিলো না’- সুরা ইউসুফ ২০

কুরআনের একটা অত্যাশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হলো— অদরকারি একটা শব্দও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা কুরআনে ব্যবহার করেন নি কুরআন কোন একটা ব্যাপার কিংবা কোন একটা শব্দ বা কোন একটা বাক্য চয়ন করেছে মানেই এটার পেছনে একটা রহস্য, একটা কারণ, একটা বার্তা লুকোনো আছে।

সাধারণভাবে মনে হতে পারে— ইউসুফ আলাইহিস সালামকে তাঁর ভাইয়েরা একেবারে যৎসামান্য দামে বিক্রি করে দিয়েছে, এখান থেকে কুরআনের পাঠক হিশেবে আমার কী শেখার থাকতে পারে?

আপনি যদি কুরআনের এক নিবিষ্ট পাঠক হোন, তাহলে আপনাকে বলতে পারি— এই ছোট্ট কথাটা থেকেও আপনি জীবনের এক গভীর পাঠ কুড়িয়ে নিতে পারেন।

আয়াতটা আমাকে এতোটা আকর্ষণ করতো না যদি না ওই আয়াতে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিতে দেখে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা এই মন্তব্য না করতেন যে— ‘মূলত ইউসুফের (মর্যাদার) ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞানই ছিলো না’।

অর্থাৎ,  আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা এখানে বলছেন— কী এক মহামূল্যবান জিনিস তারা হাতছাড়া করলো তা ওরা জানেই না।

সেই মহামূল্যবান জিনিসটা হলো ইউসুফ আলাইহিস সালাম নিজে। আল্লাহর একজন সম্মানিত নবি, এক প্রিয়তম বান্দাকে তারা অতি অল্প দামে বিক্রি করে দিলো।

আমার কাছে মনে হলো— এই একই ভুলটা আমরাও আমাদের জীবনে বারংবার করে থাকি।

ধরা যাক কোন একজন ভাই আমাকে তার খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু গোপনীয় একটা ব্যাপার জানালো। সাথে এ-ও বললো যে, আমি যেন এই তথ্য কোনোভাবেই কাউকে না জানাই।

আরো ধরা যাক, ওই ভাইয়ের কোন এক ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ওই তথ্যটা আমি জানিয়ে দিলাম। এতে করে আগের ভাইটার ব্যবসায়ে কিছু ক্ষতি হবে, কিন্তু লাভবান হয়ে যাবেন উনার ওই প্রতিদ্বন্দ্বীটাই।

মাঝখানে আমার লাভটা কী?

আমি ওই প্রতিদ্বন্দ্বীকে বললাম,  ‘যদিও আপনাকে এই তথ্য না জানানোর ব্যাপারে আমি ওয়াদা-বদ্ধ, তবুও জানালাম। কিন্তু, বিনিময়ে আপনি আমার অমুক কাজটা করে দিবেন’।

সে তো দিব্যি খুশি। ব্যবসায়িক গুরুত্বপূর্ণ অথচ গোপনীয় তথ্য পাবে কিন্তু আপনার একটা কাজ করে দিবে না তা কি হয়? সে রাজি হয়ে গেলো। আপনি তাকে গোপন তথ্যটা জানালেন, সে আপনার কাজটা করে দিলো— হয়ে গেলো শোধবোধ।

কিন্তু ওই বন্ধুটা, যে আপনাকে এতো বিশ্বাস করেছিলো যে— একটা চরম গোপন তথ্য পর্যন্ত আপনাকে জানাতে কুন্ঠাবোধ করেনি, তার ব্যাপারটা আপনি কি ভেবেছেন? ভাবেন নি।

কিন্তু জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে আপনার ওই বন্ধুটা একদিন ঠিক-ই জেনে গেলো যে— আপনি তার আমানতের খিয়ানত করেছেন। তার গোপন তথ্য তার একেবারে নিকট প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে কেবল একটা স্বার্থসিদ্ধির কারণে ফাঁস করে দিয়েছিলেন একদিন।

যেদিন আপনার বন্ধু আপনার ওই বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে জানলো, ঠিক সেদিন-ই সালাম জানিয়ে আপনার জীবন থেকে তিনি বিদায় নিয়ে নিলেন।

একজন মানুষ, যে কতো ভরসা-ভরে আপনাকে একদিন বিশ্বাস করেছিলো, তার বিশ্বাসটাকে আপনি সামান্য স্বার্থের কারণে ভেঙে চুরমার করে দিলেন। হতে পারে— আপনার ওই বন্ধুটা এমন এক বন্ধু ছিলো, যে আপনাকে প্রকৃতার্থে ভালোবাসতো, বিশ্বাস করতো, ভরসা করতো। হতে পারে— আপনার জীবনের চরম কোন বিপদে তিনিই সবার আগে এগিয়ে আসতেন। হতে পারে— তিনি আপনাকে এতো বেশি আপন ভাবতেন যে, আপনার জন্য নিজের স্বার্থকেও তিনি পায়ে ঠেলতে প্রস্তুত থাকতেন। কিন্তু সেই বন্ধুটাকে আপনি কেবল একটা খিয়ানতের কারণে জীবন থেকে হারিয়ে ফেললেন চিরতরে।

কতো সামান্য বিনিময়ের বিপরীতে আপনি কতো ভালো একটা বন্ধুকে হারালেন জীবন থেকে— ভাবতে পারেন?

এটাই হলো একেবারে যৎসামান্য মূল্যে অতি-মূল্যবান কোন জিনিস বিক্রি করে দেওয়া। ইউসুফ আলাইহিস সালামের ভাইয়েরা সেদিন বুঝতে পারেনি কোন এক অমূল্য রত্নকে তারা নামমাত্র মূল্যে হারাচ্ছে। কারো বিশ্বাস ভাঙবার আগে, কারো আমানতের খিয়ানত করবার আগে আপনিও ভাবুন কতো স্বল্প দামে আপনি কতো মহামূল্যবান বন্ধুকে জীবন থেকে হারাতে যাচ্ছেন।

আপনার জীবনে যদি কোন ইউসুফ আসে, দয়া করে তাকে নগন্য দামে বেচে দিবেন না।

আরিফ আজাদ
আরিফ আজাদ

আরিফ আজাদ একজন লেখক এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। ২০১৭ সালে 'প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ' বইয়ের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। লিখেন বিশ্বাসের কথা, চূর্ণ করেন অবিশ্বাসের আয়না। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ঘুরতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন।

Articles: 46

17 Comments

  1. Jdi condition ta hoi erkm je ,,ami ekta egency er hoye kaj kori r amr close & khub e mulloban amr jibon e …

    Ekhn se amk ekta kotha boleche jeta amr egency k janale amr companyr jonno valo but or company er lose hobe r jdi na boli thle amra lose khabo …..ei porjay e ki kora uchit hobe bole mone hoi …

  2. এমন একটি কাহিনি আমার বেলায় হইছে, এখন আমি আর আমার বন্ধু সাথে কথা বলিনা। এখন ইসলামের রিতিতে কথা না বললে কোনো সমস্যা হবে?

  3. আপনার মতো করে কখনো ভাবিনি। আজ থেকে কোন কাজ করার পূর্বে ভেবে নিব— এটা করা উত্তম নাকি না করা। আমরা জীবনে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় গভীরভাবে চিন্তা করি না। পরে হয়তো আফসোস করতে হয়। ইশ! এভাবে না করে যদি ওভাবে করতাম!
    উপকারী লিখনীর জন্য ধন্যবাদ স্যার। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন- আমীন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *