সুরা আদ-দোহাঃ নেপথ্য গল্প থেকে

সুরা আদ-দোহা আমাদের প্রায় সবার অত্যন্ত প্রিয় একটা সুরা। মন খারাপের দিনে ছোট্ট এই সুরা যেন মহৌষধ হিশেবে মুমিন ব্যক্তির জীবনে কাজ করে। আর করবেই-বা না কেনো? স্বয়ং নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য এই সুরাটা একপ্রকার ‘স্বস্তি’ হিশেবে নাযিল হয়েছিলো।

আমাদের মন খারাপের দিনে, অলস দুপুরে, উদাস বিকেলে যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে অন্তর, যখন জানা-অজানা কারণে হৃদয়টা কেবল ছটফটায়, যখন নাভিশ্বাস উঠে যায় মাঝে মাঝে, জীবন থেকে যখন আমাদের পালাতে ইচ্ছে করে, সুরা আদ-দোহা তখন যেন আমাদের ঠিক ঠিক পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। আমরা তখন তিলাওয়াত করি আর স্মরণ করি সেই আয়াতগুলো যেগুলোতে নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা শুনিয়েছেন আশা এবং ভরসার ঐশী বাণী।

‘নিশ্চয় আপনার রব আপনাকে পরিত্যাগ করেন নি আর না তিনি আপনার ওপর অসন্তুষ্ট।’ [১]

‘নিশ্চয় আপনার জন্য পরবর্তী সময় পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা উত্তম’। [২]

‘শীঘ্রই আপনার রব আপনাকে এতো পরিমাণ দেবেন যে আপনি খুশি হয়ে যাবেন।’ [৩]

দুঃখের ভারে নুইয়ে পড়া অন্তরে, বেদনায় মরচে ধরা হৃদয়ে এই আয়াতগুলো যেন রহমতের বারিধারা হয়ে ধরা দেয়। এই আয়াতগুলো যেন জীবন নিয়ে নতুনভাবে ভাবার, নতুন করে বাঁচার তাগিদ দিয়ে যায় আমাদের। আমরা উপলব্ধি করি— যে খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তা শীঘ্রই কেটে যাবে। নতুন ভোরের সোনারঙা আলোয় ভরে উঠবে আমাদের মনের উঠোন। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে এক সুন্দর পরিণতি আর এই দুঃখ সেই পরিণতিতে পৌঁছানোর সিঁড়ি মাত্র।

আমাদেরকে দুঃখের অতল গহ্বর থেকে টেনে তোলা সুরা আদ-দোহার সেই আয়াতগুলো নিয়ে আমরা অনেক ভেবেছি, ভাবি এবং ভবিষ্যতেও ভাববো, ইন শা আল্লাহ। সেগুলো থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলোকে নিজেদের জীবনে ধারণ করে আমরা সুখ আর স্বস্তিময় করে তুলবো আমাদের দুঃখের মুহূর্তগুলোকে।

তবে, সুরা আদ-দোহার আয়াতগুলো নিয়ে বেশ অনেক ভাবনা-চিন্তা করা হলেও, এই সুরা নাযিলের পেছনে যে নেপথ্য কাহিনী, সেই কাহিনীতেও রয়েছে  ভাবনার অনেক খোরাক।

সুরা আদ-দোহা নাযিলের প্রেক্ষাপট প্রায় আমাদের সকলের-ই জানা। লম্বা একটা সময়, তাফসিরকারকদের মতে প্রায় পনেরো দিন টানা ওহী নাযিল বন্ধ থাকায় নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশ চিন্তায় পড়ে যান। এদিকে এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে ভুল করেনি মক্কার মুশরিকরা। তারা সোৎসাহে বলে বেড়াতে লাগলো— ‘দেখেছো, মুহাম্মাদের রব মুহাম্মাদকে ছেড়ে চলে গেছে। তার জন্যে বার্তা নিয়ে যে আসতো, সে আর আসে না।’

ওহী নিয়ে জিবরাঈল আলাইহিস সালামের আগমন বন্ধ থাকায় নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মন এমনিতেই বেশ অস্থির আর অশান্ত। তারওপর এই প্রসঙ্গে মুশরিকদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ নবিজীর সেই মন খারাপটাকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো যেন। 

বিষণ্ণতায় ছেঁয়ে গেলো নবিজীর মন। একদিকে ওহী নাযিল বন্ধ থাকার বেদনা, অন্যদিকে মুশরিকদের ক্রমাগত মানসিক আঘাত! সবমিলিয়ে নবিজী যেন বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেন তখন।

নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সেই বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে টেনে তুলতে, তাঁর অশান্ত মনটাকে শান্ত করতে, হৃদয়ের বিপন্ন অবস্থাকে স্থির করতে এবং সর্বোপরি মক্কার মুশরিকদের অপবাদের জবাব দিতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা নাযিল করলেন সুরা আদ-দোহা।

সুরা আদ-দোহার আলোচনায় যে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা বাদ পড়ে যায় তা হলো— নেপথ্যের এই কাহিনীটা। কাহিনীটা আমরা জানি বটে, কিন্তু তা নিয়ে গভীর ভাবনা-চিন্তা কখনো হয়তো ওভাবে করা হয়নি।

নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশান্ত হয়ে পড়েছিলেন, কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা ওহী পাঠাচ্ছেন না। বহুদিন হয় জিবরাঈল ওহী সমেত তাঁর কাছে আসছে না। কেনো হঠাৎ করে ওহী আসা বন্ধ হয়ে গেলো? তবে কি তিনি কোন ভুল করে ফেলেছেন যার কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন? তবে কি তিনি নবুয়্যাতের ঝান্ডা বয়ে বেড়াবার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন? তবে কি তিনি বাদ পড়েছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের তালিকা হতে?

এই সমস্ত ভাবনা আর দুশ্চিন্তাগুলো কুরে কুরে খাচ্ছিলো নবিজীকে। এসবের কোন উত্তর তিনি কারো কাছে পাচ্ছেন না। যেকোন পরিস্থিতিতে যে জিবরাঈল আল্লাহর আদেশ নিয়ে এসে নবিজীকে পথ দেখাতো, আজ বহুদিন তাঁর দেখা নেই— এটা কি স্বাভাবিক কোন ব্যাপার!

নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তা মোটেও স্বস্তির ছিলো না। যাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা পরিত্যাগ করে, তার জীবনের আর মূল্যটাই-বা কী! মানসিক অশান্তি আর শত্রুপক্ষের নিরন্তর কথার আঘাত— সব মিলিয়ে নবিজী তখন পার করছেন জীবনের এক কঠিন সময়।

সুরা আদ-দোহা নাযিলের এই যে প্রেক্ষাপট, এখান থেকে আমাদের শিখবার কী আছে?

নবিজীর সমস্ত ব্যাকুলতা ছিলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন কি-না তা ভেবে। আল্লাহর সান্নিধ্য ছিলো নবিজীর কাছে জীবনের সবচেয়ে সেরা প্রাপ্তি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার সাথে ওহীর মাধ্যমে যে নিত্য-নৈমিত্তিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেটাই তাঁর কাছে সমস্ত প্রাপ্তি, সমস্ত চাওয়া, সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার উর্ধ্বে। এই প্রাপ্তির চেয়ে বড় কোন প্রাপ্তি নেই। এই ভালোবাসার চাইতে মধুর কোন প্রণয় নেই। এই সম্পর্কের চাইতে সুন্দর কোন বন্ধন নেই।

যখন এই প্রাপ্তিতে সাময়িক বিরতি এলো, এই প্রণয়ে যখন ঘটলো ক্ষণিকের বিচ্ছেদ, এই সম্পর্কে যখন নেমে এলো মুহূর্তের ছন্দপতন— নবিজী তখন জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা’কে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়লেন।

আল্লাহকে হারানোর এই ব্যাকুলতা, এই আবেগ, এই টান নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুভব করতে পেরেছিলেন কারণ আল্লাহর সাথে তাঁর সম্পর্কটা ঠিক ততোখানি গাঢ় ছিলো যতোখানি গাঢ় হলে বিচ্ছেদ-ব্যথা অনুভূত হয়। সম্পর্ক যতোখানি গভীর হলে তার সাময়িক বিচ্ছেদে মানুষ পাগলপারা হয়ে যায়, নবিজীর জীবনে আল্লাহর অবস্থান ছিলো সেরকম।

আমরা যদি আমাদের জীবনের দিকে তাকাই, আমাদের জীবনের কোথাও কি আমরা সেই টান, সেই ব্যথা, সেই আবেগ আর ব্যাকুলতা আল্লাহর জন্য অনুভব করি যা করতে পেরেছিলেন নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম?

আমাদের দুয়া কবুল হয় না। আমরা কি কখনো এভাবে ভেবেছি যে— আল্লাহ আমাকে পরিত্যাগ করেননি তো? এমন কোন পাপ কি আমি করেছি যার কারণে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে আমার দুয়া কবুল করছেন না?

আমাদের চাকরি হয় না। আমরা কি ভেবেছি— ‘আল্লাহ কি আমার ওপর অসন্তুষ্ট? এজন্যেই কি আমার রিযিকের রাস্তা কঠিন হয়ে উঠেছে?’

আমাদের সন্তান হয় না। আমরা কি কখনো এভাবে চিন্তা করেছি— ‘আমার কোন পাপের কারণে কি আল্লাহ আমাকে সন্তান দান করছেন না?’

আমাদের ব্যবসা থেকে বারাকাহ উঠে যায়, সংসারে অশান্তি বিরাজ করে, সময়ে-কাজে আমরা কূলিয়ে উঠতে পারি না। সালাতে মন বসে না, কুরআন তিলাওয়াতে অন্তর নরম হয় না, হারামের মধ্যে সহজে আমরা ডুবে যাই। এতোসব অন্যায়-পাপ আর পঙ্কিলতার মাঝে নিমজ্জিত হয়ে কখনো একটাবারের জন্যে আমরা নীরবে-নিভৃতে ভেবেছি কি— ‘হায়! কেনো আমার জীবনটা এতো এলোমেলো-অগোছালো? কেনো আমার জীবন থেকে ছন্দ হারিয়ে গেছে? কেনো আমার হৃদয় থেকে লুপ্ত হয়েছে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, কুরআনের জন্য প্রেম আর দ্বীনের জন্য দরদ? তবে কি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাকে সত্যিই পরিত্যাগ করেছেন? তবে কি সত্যিই আমি অনুসরণ করছি শয়তানের পদাঙ্ক? তবে কি সিরাতুল মুস্তাকীমের রাস্তা ছেঁড়ে আমি হাঁটতে শুরু করেছি জাহান্নামের রাস্তায়? হায়! আল্লাহকে হারিয়ে কী-ই বা পাওয়া হবে আমার?’

নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে যদি এই প্রশ্নগুলো আমরা করতে পারি, জীবন থেকে আল্লাহর অনুগ্রহ হারিয়ে গেছে ভেবে যদি সেভাবে ব্যাকুল হতে পারি যেভাবে ব্যাকুল হয়েছিলেন নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যদি হৃদয়ের গভীর থেকে চাইতে পারি তাঁর ভালোবাসা এবং ছেঁড়ে আসতে পারি সমস্ত অবাধ্যতা, তবে সুরা আদ-দোহার সেই সমস্ত সু-সংবাদকে আমরা আমাদের জন্যও ভাবতে পারি যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা বলছেন—

‘নিশ্চয় আপনার রব আপনাকে পরিত্যাগ করেন নি আর না তিনি আপনার ওপর অসন্তুষ্ট।’

‘নিশ্চয় আপনার জন্য পরবর্তী সময় পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা উত্তম’।

‘শীঘ্রই আপনার রব আপনাকে এতো পরিমাণ দেবেন যে আপনি খুশি হয়ে যাবেন।’

সুরা আদ-দোহা নাযিলের এই নেপথ্য কাহিনীকে যদি ধারণ করতে পারি জীবনে, আশা করা যায়, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা কখনোই আমাদের ছেঁড়ে যাবেন না।

রেফারেন্স:

১. সুরা আদ-দোহা, আয়াত-০৩

২. সুরা আদ-দোহা, আয়াত- ০৪

৩. সুরা আদ-দোহা, আয়াত-০৫

আরিফ আজাদ
আরিফ আজাদ

আরিফ আজাদ একজন লেখক এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। ২০১৭ সালে 'প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ' বইয়ের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। লিখেন বিশ্বাসের কথা, চূর্ণ করেন অবিশ্বাসের আয়না। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ঘুরতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন।

Articles: 46

307 Comments

  1. মাশাল্লা আলহামদুলিল্লাহ। এভাবে আসলেই কখনো ভেবে দেখিনি।আপনার লেখা পড়ে অন্তরে অন্য রকম প্রশান্তি অনূভুত হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে নেক হায়াত দান করুন।আর আপনাকে এমন লেখার আর ও অনেক তওফিক দান করুন যা দিয়ে আমাদের মত পাপি বান্দাদের অনেক উপকার হয়।

    আমিন

  2. May Allah give you baraka on your ilm and we can get benefits with amol. When i heard tafsir of this sura from sheik Tawfiq Chowdhury that was imaging to me again today I got new essence. Thais Nur oar Allah.
    Allah mohan.

  3. আসসালামু আলাইকুম আরিফ ভাই
    আমি ২০১৮ সাল থেকে ইসলাম অনুসরণ করে জীবন অতিবাহিত করার চেষ্টা করতেছিলাম।এখন ও করি।কিন্তু মাঝেমধ্যে একেবারেই জীবনের গতিপথ ছিটকে হারিয়ে যাই মাসের পর মাস।কিন্তু আমি আর আমার আগের অবস্থায় ফিরতে পারিনা কোন মতেই।সাধারন জীবন-যাপন এ আমি এবং আমার যে কয়েকটা বন্ধু আছে ওরাও সন্তুষ্ট না।যদিও ওরা আমার পরে ইসলামের ছায়াতলে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় আছে।এখন অনেক দূরে চলেগেছি মনে হয়।আমার জন্য দুয়া করবেন ভাই।

  4. মাশাআল্লাহ,
    গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির জন্য অভিনন্দন ভাই ‌।
    আশাকরি, আপনার আনকমন পদ্ধতিতে লেখাগুলো অব্যাহত রাখবেন, ইনশাআল্লাহ্ ।

Leave a Reply to মোঃতানভীর হোসেনCancel Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *