তিনটি  ‘ব্যবসায়িক’ পরামর্শ

স্টার্টাপ বিজনেস এবং বিনিয়োগের জন্য অভিজ্ঞতার আলোকে আমার তিনটা পরামর্শ৷ যদিও পরামর্শগুলো পুরাতন, কিন্তু নিজের উপলব্ধিটুকু বলতে চাই।

১.

দুনিয়ার অন্যতম শীর্ষ একজন ধনী ওয়ারেন বাফেট। ব্যবসা এবং বিনিয়োগের জন্য সবার কাছে সুপরিচিত। ওয়ারেন বাফেটের বিনিয়োগ নিয়ে একটা কথা আছে— ‘যদি আপনার কাছে দশটা আপেল থাকে, তাহলে কখনোই সেই দশটা আপেল একটা ঝুড়িতে রাখবেন না’।

মানে হলো— আপনার হাতে থাকা দশটা আপেল যদি একটা ঝুড়িতে রাখেন, যদি দশটার কোনো একটায় পচন ধরে, খুব সম্ভাবনা আছে বাকি নয়টা আপেলও পঁচে যাওয়ার৷ অর্থাৎ— আপনার হাতে যদি পাঁচ লাখ টাকা থাকে এবং সেই পাঁচ লাখ টাকা যদি আপনি কেবল একটা জায়গাতেই বিনিয়োগ করে ফেলেন, যদি কোনোভাবে সেই ব্যবসা যেখানে আপনি বিনিয়োগ করেছেন সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, খুব সম্ভাবনা আছে আপনার আম এবং ছালা— দুটোই যাওয়ার। ওয়ারেন বাফেটের মতে সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সেই পাঁচ লাখ টাকাকে তিনভাগ বা দুইভাগ করে তিনটা বা দুইটা আলাদা আলাদা জায়গায় বিনিয়োগ করা৷ এতে যদি কোনো একটা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অপর খাতটা টিকে থাকবে৷ দুটো যদি ভিন্ন খাত হয়, এই সম্ভাবনা একেবারেই কম যে— দুটো একইসাথে ক্ষতির মুখে পড়বে।

২.

স্টার্টাপ বিজনেসে যারা শুরুতেই সফলতা পেয়ে যায় তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে কাজটা করে তা হলো— খরচের খাত বৃদ্ধি করে ফেলা। যে খরচগুলো অনায়াসে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব সেরকম খরচগুলোতে তারা জড়িয়ে যায়— যেমন বড় অফিস, বেশি লোকবল ইত্যাদি। আমি বেশ কয়েকটা স্টার্টাপকে ভালো আগাতে দেখেও ঠিক এই খরচের লাগাম টেনে না ধরতে পারার কারণে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে অথবা সংকুচিত করে ফেলতে দেখেছি। একবছর আগে তারা আড়াই হাজার স্কয়ার ফিটের অফিস মেনটেইন করেছে, একবছর পর তারা অফিস করছে আটশো থেকে একহাজার স্কয়ার ফিট জায়গায়। কাজ কিন্তু আগের মতোই। এই যে একহাজারেও চলা সম্ভব এবং দিব্যি চলা যায়— এই বোধটা অনেকের এতো দেরিতে আসে যে— ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়।

সুতরাং যারা নতুন কিছু শুরু করতে চান, খেয়াল রাখবেন খরচের খাতটা যেন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে না যায়৷ দুনিয়া কাঁপানো বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশেরই শুরুর গল্প এমন— নুন আনতে পানতা ফুরোনোর মতো অবস্থা৷ তারা লম্বা সময় ধরে স্ট্রাগল করেছে, আস্তে আস্তে বড় হয়েছে। আপনার হয়তো জানা থাকার কথা— বাংলাদেশের স্কয়ার কোম্পানি একটা যৎসামান্য ফার্মেসী দোকান দিয়ে যাত্রা করেছিলো একদা৷

৩.

আপনি যদি একজন উদ্যোক্তা হোন এবং নিজের মতো করে কিছু একটা করতে চান, তাহলে আপনার জন্য আমার প্রথম পরামর্শ হলো— যা করতে চাইছেন তা আদৌ কি আপনার স্বপ্ন?

এই জায়গাটায় অধিকাংশ মানুষ একটা ভুলটা করে। স্বপ্ন সবসময় বিজনেসও, কিন্তু বিজনেস সর্বদা স্বপ্ন নয়।

একটু খোলাসা করা যাক৷ ধরা যাক আপনার স্বপ্ন আপনি এমনকিছু প্রোডাক্ট তৈরি করবেন যা মানুষের কল্যাণে লাগবে এবং একইসাথে সেগুলো আপনার হালাল রিযিকের মাধ্যমও হবে। আরো ধরা যাক এই চিন্তা থেকে আপনি ঠিক করলেন যে আপনি একজন প্রকাশক হবেন এবং ভালো ভালো বই প্রকাশ করবেন যা মানুষকে কল্যাণের পথ দেখাবে। খুব ভালো চিন্তা। এখন আপনি বই প্রকাশ করলেন ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ করলেই যে সেগুলো বিক্রি বাট্টা হয়ে যাবে এবং আপনার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রাতারাতি আসমানে উঠে যাবে— বিষয়টা কিন্তু তা নয়৷ সেই বইগুলোকে পরিচিত করাতে, পাঠকমহলের আগ্রহ তৈরি করতে প্রকাশের বাইরেও আপনাকে নানান কর্মযজ্ঞের ভেতর দিয়ে যেতে হবে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে৷

কিন্তু, একটা, দুইটা, তিনটা, চারটা— কোন বই-ই আপনার সন্তোষজনক বিক্রি-বাট্টা হচ্ছে না৷ এমতাবস্থায় আপনি কী করবেন? হ্যাঁ, যদি বই প্রকাশটা আপনার স্বপ্নের কাজ হয়, আপনি দাঁতমুখ চেপে এই কাজে লেগে থাকবেন— ব্যবসা যতো কম হোক৷ আপনার কাজ হচ্ছে স্বপ্নের পেছনে লেগে থাকা এবং আপনি এ-ও জানেন— লেগে থাকলে ব্যবসা একদিন হবেই ইন শা আল্লাহ।

কিন্তু, বই প্রকাশটা যদি আপনার স্বপ্ন না হয়, অন্যরা বেশ ভালো আয়-রোজগার করে ফেলছে প্রকাশনা খুলে— যদি স্রেফ এই চিন্তা থেকে আপনি প্রকাশনা ব্যবসাতে আসেন, তাহলে ব্যবসা হচ্ছে না এটা বোঝা মাত্রই আপনি তল্পিতল্পা গুছিয়ে বিদেয় নিবেন এখান থেকে৷ আপনার আগ্রহ তখন চলে যাবে অন্য জায়গায়— জুতো ফ্যাক্টরি, খাবারের ব্যবসা, আতর, খেঁজুর অথবা মধুর ব্যবসাতে৷ কারণ সেখানেও আপনি কিছু ‘সফল’ লোকদের দেখতে পাচ্ছেন আর ভাবছেন ওখানে গেলেই বুঝি ব্যবসা হয়ে যাবে৷

স্বপ্নের পেছনে লেগে থাকলে যে ব্যবসাও হয় তার একটা সফল উদাহরণ হলো ব্র‍্যাক৷ তারা তাদের আদর্শ আর বিশ্বাসকে সামনে রেখে আগাচ্ছে— ব্যবসাও হচ্ছে, স্বপ্নও পূরণ হচ্ছে৷ দেখুন— আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা পালিয়েছে, কিন্তু ব্র‍্যাক তার কাজের মাধ্যমে সদলবলে এখনো টিকে আছে আফগানিস্তানে— সেই ২০০২ সাল থেকে৷
এটাই হচ্ছে স্বপ্নবাজ আর ব্যবসায়ীদের মাঝে মৌলিক পার্থক্য।
(কেউ আমাকে ব্র‍্যাকের গুণগ্রাহী ভেবে বসবেন না যেন। এটা স্রেফ একটা উদাহরণ শুধু)।

না, আমি বলছি না যে ব্যবসা করতে হলে আপনাকে স্বপ্নবাজ হতে হবে অথবা স্বপ্নবাজ না হলে ব্যবসা করা যাবে না৷ তবে— জীবন তো একটাই, তাই পদক্ষেপগুলো ভেবেচিন্তে নিলে জীবনটা অনেকবেশি অর্থবহ হয়— এই আর কী!

আরিফ আজাদ
আরিফ আজাদ

আরিফ আজাদ একজন লেখক এবং সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। ২০১৭ সালে 'প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ' বইয়ের মাধ্যমে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। লিখেন বিশ্বাসের কথা, চূর্ণ করেন অবিশ্বাসের আয়না। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ঘুরতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন।

Articles: 46

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *