(১)
আজ সম্ভবত পূর্ণিমা রাত। আজকের চাঁদের আকৃতি বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় খানিকটা বড় হবে।
বাড়ির ছাদে বা উঠোনে বসে যদি আপনি আকাশের দিকে তাকান, মেঘমুক্ত আকাশ হলে আপনি ঝকঝকে এক অপরূপ চাঁদের দেখা পাবেন আজ। ধূসার-শাদা জোছনায় প্লাবিত হবে আপনার চারিপাশ।
সুন্দর সেই ঝকঝকে আকাশে চাঁদের বাইরেও আপনি দেখতে পাবেন অসংখ্য অগণিত তারা যারা মিটিমিটি জ্বলছে পুরো আকাশজুড়ে। তাদের অবস্থান কিন্তু আমাদের জানাশোনা, নিকটবর্তী কোন স্থানে নয়। বহু বহু আলোকবর্ষ দূরের কোন মহাশূন্যে তারা অবস্থান করছে ধারণার উর্ধ্বেরও কোন সময়কাল থেকে। তাদের একেকটার আকার আর আকৃতি আমাদের ধারণার চাইতেও বহু বহু গুণ বড় হতে পারে অনায়াসে। হতে পারে— আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় নক্ষত্র, যাকে আমরা সূর্য নামে ডাকি, সেই সুবিশাল সূর্য সেই তারকাগুলোর কাছে শস্যদানার মতোই ক্ষুদ্র!
ভাবছেন, সেই তারকাগুলোর তুলনায় সূর্য যদি এতো ছোট-ই হবে, তাহলে সূর্যের আলো এতো বেশি কেনো? আর, সেই তারকাগুলোকে কেনো দেখি একেবারে নিঁভু নিঁভু পিদিমের আলোর মতোন?
এর কারণ হলো— সেই তারকাগুলোর তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান সূর্যের অধিক নিকটে। সূর্য থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ৮ মিনিট ১৯ সেকেণ্ড। কিন্তু ওইসব তারকা, যেগুলোকে আমরা নিভতে থাকা পিদিমের আলোর মতো দেখি রাতের বেলা, সেগুলোর আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে সময় লেগে যায় কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার বছর! তাহলে ভাবুন সূর্য আমাদের কতো নিকটের প্রতিবেশী! এতো কাছের প্রতিবেশি বলেই সূর্যের নক্ষত্র-চরিত তেজস্বী রূপটা আমরা কিছুটা দেখতে পাই। কিন্তু— হতে পারে সূর্যের চাইতেও হাজারগুণ তেজস্বী কোন নক্ষত্রের আলোকে আমরা মৃদুমন্দ আলোকচ্ছটার মতো রাতের বেলা অবলোকন করি কারণ তারা আছে আমাদের ধারণাতীত দূরত্বে।
(২)
তার মানে কী?
ধরা যাক, আমি এখন আমার বাসার ছাদে বসে আছি। তাকিয়ে আছি আকাশের একটা কোণায় টিমটিম করে জ্বলতে থাকা একটা তারার দিকে। আরো ধরা যাক তারাটার নাম ‘মনোহরা’, এবং সেই তারাটা আছে পৃথিবী থেকে চারশো বছরের দূরত্বে।
এই যে আমি এখন মনোহরার দিকে তাকিয়ে আছি, তার টিমটিমে যে আলোকচ্ছটা আমি প্রানভরে উপভোগ করছি, এই আলোটা কি ঠিক আজকের? অর্থাৎ— ঠিক এই মুহূর্তেই মনোহরা তারকা থেকে নির্গত হয়ে সে আলো আমার চোখে এসে লাগছে?
মোটেও তা নয়। আমি এখন মনোহরার যে আলোটা দেখতে পাচ্ছি, মনোহরা থেকে তা যাত্রা শুরু করেছে আজ থেকে আরো চারশো বছর আগে! অর্থাৎ— বাংলায় যখন মুঘল বংশের শাসন চলছিলো, ঠিক ওই সময় এই আলোটুকু মনোহরা থেকে পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করে এবং এই এতোগুলো বছর পরে, সেই আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে এবং আমার চোখে তা ধরা পড়েছে। পৃথিবীর দিকে যাত্রার সময়কালে, মনোহরা হয়তো পুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছে তার নিকটবর্তী কোন গ্রহ কিংবা উপগ্রহের পৃষ্ঠদেশ! যে আলো পুঁড়িয়ে এসেছে একটা স্থানকে, অন্য স্থানে সে মোমের আলোর মতো নরম আর সফেদ! মজার না, ব্যাপারটা?
আরো মজার কি জানেন? এমনও হতে পারে— মনোহররা যে আলোটা এখন আমি উপভোগ করছি, চারশো বছর আগে সে আলো যাত্রা করার ঠিক পরেই হয়তো ধ্বংস হয়ে গেছে মনোহরা। বিলীন হয়ে গেছে মহাশুণ্যে। কিন্তু তার ধ্বংসের আগেই যেহেতু আলোটা যাত্রা করে ফেলেছে, তাই তারকা হিশেবে মহাশূণ্যের মহাখাতায় মনোহরা এখন অতীত হলেও, আমার চোখে সে দিব্যি বর্তমান!
(৩)
আচ্ছা, তাহলে আমি আসলে কী বলতে চাচ্ছি?
হুম, আমি আসলে বলতে চাচ্ছি— ছাদে বসে আমি এই মুহূর্তে মনোহরার মতো যেসকল তারকার আলো দেখতে পাচ্ছি, তাদের মিটিমিটি জ্বলা আর নিভে যাওয়াটাকে উপভোগ করছি— তার কোনোটাই বর্তমান নয়। এগুলো সব অতীতে যাত্রা করা আলো, কিন্তু বি-শা-ল দূরত্বের কারণে তা আজ, ২০২২ সালের ১৩ ই জুলাই আমি ছাদে বসে উপভোগ করছি। এমনকি— দিনের বেলা সূর্যের যে আলোটা আমার গায়ে এসে লাগে, সেটাও তৎক্ষনাৎ সূর্য থেকে এসে লাগে না। সেই আলোটা সূর্য থেকে রওনা করেছে আরো ৮ মিনিট আগে। অর্থাৎ— আমার কাছে সূর্যের যে আলোটা বর্তমান, সেই আলোটা সূর্যের কাছে আরো আট মিনিট অতীতের।
(৪)
নাসার জেমসওয়েব টেলিস্কোপের কল্যাণে সম্প্রতি মহাকাশের এখন পর্যন্ত পাওয়া সুপ্রাচীন একটা ছবি আমরা দেখতে পেয়েছি। ছবিটা সারাবিশ্বে হৈচৈ ফেলেছে। নিঃসন্দেহে একটা দারুন মাইলফলক এটা জোতির্বিজ্ঞানের। তবে— যারা খুব হৈচৈ করছেন এই বলে যে— নাসা আমাদের অতীত দেখিয়েছে, জেমসওয়েব এই সময়ের টাইম ট্রাভেল মেশিন ইত্যাদি বলে, তাদের অবগতির জন্যেই উপরের লম্বা ফিরিস্তিটা— এমন অতীত তো আমরা প্রত্যেকদিন-ই দেখছি। হ্যাঁ, নাসা আমাদের এমন অতীত একটা দৃশ্য দেখিয়েছে যা কোনোদিনও আমরা খালি চোখে দেখতে পেতাম না।
(৫)
কতিপয় বিজ্ঞান-পূজারী, যারা অপেক্ষায় থাকেন বিজ্ঞানের যেকোন অবদানে বিশ্বাসীদের একহাত নেওয়ার, তাদেরও কিছু কাণ্ডকারখানা দেখলাম বটে।
জেমসওয়েবের এই আবিষ্কারের খবরে যারা ‘সুবহান-আল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার প্রশংসা করছে, তাদের নিয়ে তারা খুব হাসাহাসি করছেন। আমি বুঝতে পারলাম না এখানে হাসাহাসি করার কোন উপাদান তারা খুঁজে পেলেন!
যেকোন বিস্ময়কর বস্তু, আবিষ্কার আর জ্ঞানের দেখা মিললে মুসলমানরা আল্লাহর প্রশংসা করে থাকে। আমরা বিশ্বাস করি— এই আশ্চর্য সৃষ্টি অবশ্যই স্রষ্টার নৈপুণ্যের প্রমাণ বহন করে।
এমন তো নয় যে— নাসা জেমসওয়েব টেলিস্কোপের সাহায্যে সেই নক্ষত্র, গ্যালাক্সিগুলোকে মহাকাশের ওই সু-বি-শা-ল দূরত্বে স্থাপন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এরকম অত্যাশ্চর্যের কিছু একটা আছে, জেমসওয়েব সেটা দেখিয়েছে, কেনো আছে, কে সেগুলোকে তৈরি করেছে তা তো জেমসওয়েব বলেনি এবং এটা জেমসওয়েবের কাজও না৷ হ্যাঁ— স্রষ্টাকে কৃতিত্ব না দিতে চাওয়া লোকেরা সেগুলো কীভাবে তৈরি হয়েছে তার কতিপয় ব্যাখ্যা দাঁড় যে করায় না তা নয়। এসবের পেছনে কোন এক বুদ্ধিমান সত্ত্বার হাত আছে সেটা তারা স্বীকার করবে না, তার স্থলে বলবেন— এগুলো বিগ ব্যাংয়ের ফলে তৈরি, কখনো বলবে এগুলো বিগ ক্রাঞ্চের কারণে সৃষ্ট, কখনো-বা বলবে এগুলো ট্রি অব লাইফের অংশ, আবার কখনো বলবে এগুলো স্টার ডাস্টের ব্যাপার স্যাপার। এসব দাবি তারা করতেই পারেন। কিন্তু এতো অনিন্দ্য সুন্দর ব্যবস্থাপনা, কারুকার্য আর কারিশমা দেখে আমরা যদি তাতে কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার অস্তিত্ব স্বীকার করে তৃপ্ত হতে চাই, এসব মুক্তচিন্তার পতাকাধারীরা তাতে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে কেনো?
(৬)
কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা সাত আসমান সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন৷ আমি এমন অনেক ইসলাম বিদ্বেষীকে দেখেছি যারা এই সাত আসমানের কথা তুলে হাসাহাসি করে। তারা বলে— সাত আসমান আবার কী জিনিস? এমনটা হয় নাকি?
কিন্তু, নাসার জেমসওয়েব টেলিস্কোপ যখন মহাকাশের এই সুপ্রাচীন ছবিটা ছেড়ে বললো— ছবিতে অসংখ্য গ্যালাক্সি, নক্ষত্র যে জায়গা দখল করে আছে, তা মহাশূণ্যের তুলনায় একটা শস্যদানার সমান, এর বাইরে অজানা থেকে যাচ্ছে কল্পনাতীত একটা মহাশূন্য-জগত, তখন এসব অবিশ্বাসীর দল ব্যাপক বিস্ময়ের সহিত বলছে— Wow! What a mysterious universe we’re living in!
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা বলেছেন— ‘আমি নিকটবর্তী আসমানকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা দিয়ে’- আল মুলক ০৫
এই আয়াত থেকে আমরা অনুমান করতে পারি— আমাদের দৃষ্টিসীমার মাঝে থাকা আকাশ, যেখান থেকে বিচ্ছুরিত হয় নক্ষত্রের আলো, এবং যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না, যা দেখার জন্য আমাদের সাহায্য নিতে হয় হাবল অথবা জেমসওয়েব টেলিস্কোপের— এসবগুলোই প্রথম আসমানে থাকা আল্লাহর সৃষ্টিরাজি। নাসা তার ক্যারিয়ারের সর্ববৃহৎ আবিষ্কারটাকেই যদি বলে— মহাশূন্যের মাঝে এটা একটা শস্যদানার মতো, তাহলে কতো বিস্তৃত হতে পারে শুধুমাত্র প্রথম আসমানের পরিধি যা মহান রব সাজিয়েছেন নক্ষত্রমালা দিয়ে?
এই যদি হয় প্রথম আসমানের ব্যাপার, তাহলে বাকি সাত আসমানে কী রহস্য লুকিয়ে আছে ভাবুন তাহলে!
সুবহানাল্লি ওয়া-বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আ-যীম!
লেখা টা পরলাম । লেখক নিজেই ৭ আসমান এর বিষয় টা নিয়ে clear কিনা আমার সন্দেহ ।
– ” পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা বলেছেন— ‘আমি নিকটবর্তী আসমানকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা দিয়ে’- আল মুলক ০৫ ”
লেখক এর জানা উচিত উনি যে কুরান এবং বিজ্ঞান কে নিয়ে hype করছেন ওখানে আসমান বলতে কি বুঝিয়েছে তা clear না ! আসমান শব্দটা ও কতটা যৌক্তিক ? বিজ্ঞান আসমান শব্দটাকে আদৌ support করে ?
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহি ওবারাকাতুহ,, আজাদ ভাই। সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ। মহান আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি কতোই না সুন্দর। কতোই না বিস্ময়কর। যত দেখি, যত পড়ি, যত শুনি ততই মুগ্ধ হই।
আজাদ ভাই, আমরা বাঙ্গালীরা খুবই গর্বিত আপনার মতো একজন লেখকে পেয়ে,, আলহামদুলিল্লাহ। আপনার লেখা পড়ে নতুনভাবে ভাবতে উদ্ধুদ্ধ হই। আপনার লেখা এক নতুন ভাবনার সৃষ্টি করে।
আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে নেক হেদায়েত দান করুন এবং এক অনন্য লেখক হিসেবে আল্লাহর দিনের পথে অটল থাকার তৌফিক দান করুন , আমিন।।
আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আরিফ আজাদ ভাইয়ের,,,, লেখা গুলো অনেক চমৎকার। তার এই ইসলাম কে নিয়ে গভীর চিন্তা ভাবনা আমার অনেক ভালো লাগে। প্রতিটা মুসলিমের এই মনোভাব ধাকা অবশ্যই ধরকার।
SubhanAllah
সুবহানাল্লা ওয়া-বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আযীম।
আলহামদুলিল্লাহ
Tremendous as always. Jazakallh Vai….
ageo porechilam, abar porlam.
Alhamdulillah