(১)
কয়েকদিন আগে ফেইসবুকে আমার একটা লেখার নিচে একজন লিখলো, ‘ভাইয়া, আপনার মেয়ে আয়িশাকে নিয়ে আর লেখেন না কেনো ফেবুতে?’
প্রতি-উত্তরে আমি বললাম, ‘বদ-নজরের ভয়ে লিখি না। আমি খেয়াল করেছি— যখনই তাকে নিয়ে আমি ফেবুতে কিছু লিখি, ও কোনো না কোনোভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে’।
আমার এই প্রতি-উত্তর স্বাভাবিকভাবেই অনেকের নজরে আসে এবং অধিকসংখ্যক মানুষ আমার কাছে ফিরতি জানতে চাইলো— ‘ভাই, আপনি কি বদ-নজরে বিশ্বাস করেন?’ ‘ভাই, বদ-নজর বলে আদৌ কি কিছু আছে?’ ‘বদ-নজর সম্পর্কে ইসলামের ধারণা কী?’
প্রতি-উত্তরগুলো দেখে মনে হলো— বদ-নজর সম্পর্কে আমাদের অনেকের ধারণা সু-স্পষ্ট নয়। আমরা কেউ এটাকে বিশ্বাস করি না, কেউ ভাবি এটা ইসলামের সাথেই যায় না বা ইসলাম বদ-নজরেই বিশ্বাস করে না, কেউ-বা এটাকে কু-সংস্কার ভাবি। এই প্রতিক্রিয়াগুলো দেখে মনে হলো কিছু একটা লিখা দরকার। সেই চিন্তা থেকেই এই লেখাটুকুর অবতারণা।
প্রথম কথা হলো— ইসলামে কু-সংস্কারের কোন স্থান নেই। যেমন গ্রামগঞ্জে মানুষ বিশ্বাস করে— কোথাও যাওয়ার পথে কালো দোয়েল পাখি দেখলে সে যাত্রা শুভ হয় না। বাড়ির ওপরে এসে ভর-দুপুরে কাক ডাকা মানে আসন্ন কোন বিপদের পূর্বাভাস। কোন কাজে যাওয়ার জন্য বেরুতে গিয়ে যদি হোঁচট খায়, তাহলে কাজটা ভালো না হওয়ার ইঙ্গিত।
এমনসব কু-সংস্কারে পরিপূর্ণ আমাদের গ্রাম্য-সমাজ। এ-জাতীয় কোন উদ্ভট ব্যাপারে ইসলামের কোন সমর্থন নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো তো কু-সংস্কার বটেই, কোন কোন ক্ষেত্রে সেগুলো শিরক আর কুফরের মধ্যেও মানুষকে টেনে নিয়ে যায়।
কিন্তু বদ-নজর সেরকম নয়। কুরআন এবং সুন্নাহতে এটার পক্ষে যথেষ্ট দলীল পাওয়া যায়।
সূরা ইউসুফের ৬৭ নম্বর আয়াতে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম যখন তাঁর পুত্রদের মিশরে পাঠাচ্ছিলেন, তখন বাড়তি করে বলে দেন যে— ‘এবং তিনি বললেন, ‘আমার প্রিয় সন্তানেরা! শহরে প্রবেশকালে তোমরা এক দরোজা দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং ভিন্ন ভিন্ন দরোজা দিয়ে প্রবেশ করবে’।
তাফসিরকারকগণ নবি ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ‘এক দরোজা দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং ভিন্ন ভিন্ন দরোজা দিয়ে প্রবেশ করবে’— কথাটা থেকে এই অর্থ নিয়েছেন যে— ছেলেদের ব্যাপারে তিনি বদ-নজরের আশঙ্কা করেছিলেন। কারণ নবি ইয়াকুব আলাইহিস সালামের সকল সন্তানেরাই ছিলো অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান, সুঠাম দেহের অধিকারী এবং অধিকন্তু অত্যন্ত সু-দর্শন। লোকজন যখন জানবে যে এই সবগুলো (ইউসুফ আলাইহিস সালাম ব্যতীত বাকি এগারোজন) একই পিতার সন্তানাদি, তখন বদ-নজর লেগে যেতে পারে। তাই ইয়াকুব আলাইহিস সালাম আগ থেকেই সন্তানদের সাবধান করে দিয়েছেন। [১]
কুরআনের এই আয়াত স্পষ্ট প্রমাণ করে যে— বদ-নজর কোন কু-সংস্কার নয়, তা সত্য। তাছাড়া নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেকগুলো হাদিসে বদ-নজরের ব্যাপারে বলা আছে। তন্মধ্যে বুখারীর একটা হাদিসে সরাসরিই আছে, নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন— ‘বদ-নজর সত্য। [২] তার মানে হলো— বদ-নজর লাগে। এর প্রভাব আছে।
(২)
বদ-নজরের সাধারণ কারণ হলো ঈর্ষা আর হিংসা। অর্থাৎ— কারো কোন প্রাচুর্য, প্রাপ্তি কিংবা লাভ দেখে যখন অন্যকেউ তাকে ঈর্ষা বা হিংসা করে, তখন ওই ব্যক্তি যে কোনোকিছু লাভ করেছে, তার ওপরে হিংসা-কারীর বদ-নজর লাগতে পারে। তবে— হিংসা বা ঈর্ষাকারী যে ওই ব্যক্তির ক্ষতি চায় বলেই বদ-নজর লাগে তা নয়, বরং ওই প্রাপ্তি দেখে তার মধ্যে সেটা লাভের জন্য যা হাহাকার তৈরি হয়, সেই হাহাকার থেকেই বদ-নজরের উৎপত্তি।
তার মানে কি, আমরা কারো কোন প্রাপ্তির সংবাদ, কারো ভালো কোনোকিছু সম্পর্কে জানতে চাইতে পারবো না?
ব্যাপারটা তা নয়। অবশ্যই কারো কোন ভালো অর্জন, প্রাপ্তি বা লাভ সম্পর্কে আমরা জানতে পারবো, তবে সেই অর্জন আর প্রাপ্তির কথা শোনার সাথে সাথে প্রথমত আমরা আল্লাহর প্রশংসা পাঠ করবো, দ্বিতীয়ত তার জন্যে আমরা দুয়া করে দেবো। এই দুটো কাজ করা গেলে কারো আর আমাদের বদ-নজর লাগবে না, ইন শা আল্লাহ।
কেউ গাড়ি কিনেছে দেখলে বা শুনলে আমরা বলবো, ‘মা শা আল্লাহ! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আপনার তাওফিক আরো বাড়িয়ে দিন’।
কেউ ভালো রেজাল্ট করেছে শুনলে বলবো, ‘মা শা আল্লাহ! আল্লাহ আপনার জ্ঞান আর যোগ্যতা আরো বাড়িয়ে দিন’।
কেউ হজ্বে যাচ্ছে শুনলে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আপনার হজ্বকে কবুল করে নিন’।
কারো বাচ্চা খুব মেধাবি জানতে পারলে বলবো, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লা’হা! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা তাঁকে দ্বীনের জন্য কবুল করে নিন’।
কারো দাম্পত্যজীবন খুব সুখে কাটছে শুনলে বলবো, ‘মা শা আল্লাহ! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আপনাদের সংসারে আরো ভরপুর বারাকাহ দিন’।
এভাবে আমরা যদি মানুষের ভালো সংবাদগুলো শোনামাত্রই যদি আমরা আল্লাহকে স্মরণ করি আর তাদের জন্য দুয়া করি— আমাদের বদ-নজর থেকে তখন তারা হেফাযত হয়ে যাবেন, ইন শা আল্লাহ।
(৩)
আমাদের মূল কথাবার্তা শেষ, আলহামদুলিল্লাহ। তবে এই অংশটা তাদের জন্য, যাদের মনে একটু খুঁতখুঁতানি, একটু আমতা আমতা ভাব অবশিষ্ট থেকে গেছে। যারা ভাবছেন, ‘কিন্তু, বদ-নজর ধর্মে আছে মানলাম, এটার ব্যাপারে বিজ্ঞান কী বলে?’
প্রথমেই বলে নিই— আল্লাহর কিতাব আল কুরআন এবং নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহতে যখন স্পষ্টভাবে দলিল আছে, সেটা মেনে নেওয়ার জন্যে তখন কোন বিশ্বাসী মানুষেরই মনে আর কোন ‘যদি-তবে-কিন্তু’ থাকা উচিত নয়। আমাদের হতে হবে আবু বাকার রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতোন মুসলিম। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল বলেছেন? ব্যস! কুরআনের ভাষায়— ‘শুনলাম এবং মেনে নিলাম’।
কিছুকাল আগ অবধিও এই ‘বদ-নজর’ তথা ‘ইভিল-আই’কে পশ্চিমা দুনিয়াতে ‘কু-সংস্কার’ জ্ঞান করা হতো। কিন্তু, ২০১০ সালে Collins A. Ross নামের একজন রিসার্চার Evil-Eye এর উপরে গবেষণা করে বলেছেন— বদ-নজর কু-সংস্কার নয়, এটার সাইন্টিফিক কারণ আছে। এটার উপরে তিনি একটা রিসার্চ পেপার তৈরি করেন ‘Electrophysiological basis for the Evil-Eye belief’ শিরোনামে। ‘Anthropology of Consciousness’ নামক জার্নালে সেটা প্রকাশিত হয়।
বিজ্ঞান এটা নিয়ে কী বললো, কী করলো তা মূল ব্যাপার নয়। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যা বলেছেন তা-ই আমাদের জন্য বিশ্বাস, তা-ই আমাদের জন্য দ্বীন।
আমাদের সকলকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা বদ-নজর থেকে হেফাযত রাখুন।
রেফারেন্স:
১. উক্ত আয়াতের তাফসির ইবনে কাসীরের আলোচনা দ্রষ্টব্য।
২. সহীহ আল বুখারী, ১০/২১৩
সময়োপযোগী লেখা
আপনার ঔ উত্তর দেখেই ভাবছিলাম যে,যারা এ ব্যপারে জানে না,তারা এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।
আল্লাহর শুকরিয়া এজন্য যে,বিষয়টি আপনার দৃষ্টি গোচর হয়েছে আর তার উত্তর দিয়েছেন।
Hmmm
আসসালামু আলাইকুম। প্রিয় ভাইজান, বদ নজর থেকে বাঁচতে কি করণীয় তা জানালে উপকার হত।
বেশ বলেছেন প্রিয়, ভাই !!
Mashallah vaijan
মা শা আল্লাহ! আল্লাহ আপনার লেখায় আরও বরকত দান করুক।
কাও কারো ক্ষতি করতে চাইলে যদি বদ নজর দেয় তাহলেই তো হয় গেলো!এতে তার কার্য হাসিল??জানাবেন ভাই
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আপনার লেখনিতে আর ও বারাকা দান করুন।
Masha Allah. May Allah bless you For your amazing writing skill.
মাশাআল্লাহ প্রিয় ভাইয়া