কুরবানির ঈদের সময়ে বাড়িতে এলে প্রায়ই একটা কথা কানে আসে— ‘অমুকের শ্বশুরবাড়ি থেকে গরু দিয়েছে’, ‘তমুকের শ্বশুরবাড়ি থেকে বড় ছাগল দিয়েছে’।
আমি নিজে একজন খাস চট্টগ্রামের মানুষ হয়েও এ-কথা অস্বীকার করবো না যে— চট্টগ্রামে যতো প্রকারের অপ-সংস্কৃতি চালু আছে তা গোটা বাংলাদেশেই বিরল। আর সেই অপ-সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায়ে আছে যৌতুক প্রথা।
যৌতুক জিনিসটাকে এখানকার সমাজ এতো সহজ আর সাবলীলভাবে গ্রহণ করেছে যে— কেউ যদি যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় অথবা নিজে যৌতুক ছাড়া বিয়ে করে, গোটা সমাজ তার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায় যেন সে খুব বোকা শ্রেণীর মানুষ যে সম্পদ লাভের এমন মোক্ষম সুযোগ হেলায় হারাচ্ছে। কেউ কেউ আবার আরো এককাঠি সরেস। তারা ভাবে— ‘ছেলের মনে হয় সমস্যা আছে, নাহয় কিছু নেওয়া ছাড়া বিয়ে করে নাকি?’
চট্টগ্রামে যৌতুক প্রথা এমন মহামারী রূপ কীভাবে ধারণ করলো তা আমি বেশ অনেকদিন থেকেই বোঝার চেষ্টা করছি। অনেক মানুষের সাথে আমি এ-বিষয়ে আলাপ করেছি। সবশেষে যে উপসংহারে আমাকে পৌঁছাতে হলো তা এই— কোন এক কালে বড়লোক বাবারা তাদের আদরের দুলালীদের বিয়ে দেওয়ার সময় সাথে গাড়ি বোঝাই করে জিনিসপত্র দিতেন। জিনিসটা নিতান্তই ‘উপহার’ হিশেবে শুরু হলেও, আস্তে আস্তে সমাজ সেটাকে এমনভাবে গ্রহণ করে নিলো যে— তা এখন এখানকার বাবাদের, বিশেষ করে দরিদ্রশ্রেণীগুলোর, গলার কাঁটা হয়ে আছে।
গতবার যখন বাড়ি এলাম, একলোক এসে আমার হাত ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। ভদ্রলোক জীবনের লম্বা সময় স্কুলের মাস্টারি করেছেন। জীবনের সঞ্চয়গুলো দিয়ে কোনোভাবে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ঘরে তার আরো একটা বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে এবং তার জন্যে আসা প্রায় সব সম্বন্ধই ফিরে যাচ্ছে যৌতুকের কারণে। স্কুল মাস্টারের আর ক্ষমতা নেই বরপক্ষের চাহিদা মোতাবেক যৌতুক দেওয়ার। তিনি আমার কাছে মেয়ের বিয়ের জন্য কিছু সাহায্য চাইতে এসেছেন।
যৌতুক-প্রথার এই গ্যাঁড়াকলে পড়ে চোখের সামনে কতো পরিবারকে যে সর্বস্বান্ত হতে দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। অথচ, যদি যৌতুকের দায়ে তাদের পড়তে না হতো, এদের প্রত্যেকেই বেশ সচ্ছলতার সাথে কাটাতে পারতো তাদের জীবন। এদের জমি ছিলো, ব্যবসা ছিলো, দোকানপাট ছিলো। মেয়ে বিয়ে দিতে গিয়ে সব বিক্রি করে আজ তারা একপ্রকার পথের ভিখারি!
বিয়ের সময়ে যৌতুক নিয়েই কেবল এরা শান্ত হয় না, রামাদানের ঈদে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সকলের জন্য (সকলের জন্য বলতে অনেকসময় ছেলের বোন, বোনের জামাই, বোনের ছেলে-মেয়ে, ভাইয়ের পরিবার সহ মামা-চাচাদের জন্যও) মেয়ের বাবাকে নতুন কাপড়-চোপড় কিনে পাঠাতে হয়। সেই কাপড় আবার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেদের পছন্দ না হলেও বিপদ। মেয়েকে শুনতে হবে সাত-পাঁচ কথা!
ফলের মৌসুমে আম-কাঁঠাল, পিঠার মৌসুমে ভাপা-পুলি পিঠা, এমনকি মেয়ের বাচ্চা হলেও মেয়ের বাপকে খাবার-দাবার, কাপড়চোপড় নিয়ে ঘটা করে হাজির হতে হয়।
আর বিয়ের নতুন বছরে কুরবানির ঈদের সময়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দেওয়া লাগে গরু অথবা ছাগল। যদি তা না-ও পারে, অন্তত কিছু টাকা হয় ছেলের হাতে অথবা ছেলের বাবা-মা’র হাতে গুঁজে দিয়ে বলতে হয়, ‘বেয়াই, আমার সামর্থ্য সম্পর্কে তো জানেন আপনারা! জানি এই সময়ে গরু/ছাগল দেওয়ার নিয়ম, কিন্তু আমি যে নিরুপায়। এই টাকা ক’টা রাখেন দয়া করে’।
বিয়ে জিনিসটা এখানে বড্ড কঠিন! অথচ এদের সকলে ঈমানদার মুসলিম। একটা জঘন্য হারাম দিয়ে এরা শুরু করে তাদের নতুন জীবন। ইসলাম বিয়েটাকে কতো সহজ করেছে। এখানকার ছেলের বাবা-মায়েরা মনে করে— বিয়ে করে তারা বউ আনছে না আসলে, ঘরের একটা সদস্য বাড়াচ্ছে যে ভাত খায়, যার কাপড়চোপড় লাগে, তেল-সাবান লাগে। সারাজীবন ধরে এইসব খরচ সামলাতে যেহেতু অনেক টাকা খরচ হবে, তাই অন্তত কিছু টাকা বিয়ের সময়ে মেয়ের বাপ থেকে উসুল করে নেওয়া যাক। একেবারে ফ্রিতে খাওয়াবে কেনো!
এই জঘন্য অপ-সংস্কৃতিকে সমাজ থেকে দূর করতে চট্টগ্রামে আমাদের জেনারেশানকে দায়িত্ব নিতে হবে। দরকারে সমাজ আর পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে তাদের। যৌতুক প্রথার নামে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে তারা বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে না— এমন মানসিকতা ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করলেই সমাজ থেকে এই বিষফোঁড়া দূর হবে, ইন শা আল্লাহ।
তবে, মেয়ের বাবাদেরও এখানে করবার আছে অনেককিছু। দশ-বিশ লাখ টাকা মোহরানার নামে তারা যে দড়ি ছেলেদের গলায় ঝুঁলিয়ে দিতে চায়, তা কোনোভাবেই ইসলাম সম্মত নয়। মোহরানা নির্ধারণ হবে ছেলের সামর্থ্য অনুযায়ী। যে ছেলের মাসিক আয় বিশ হাজার, তার গলায় কেনো ঝুলিয়ে দেওয়া হবে পনেরো লাখ টাকা মোহরানার দায়?
পরিবর্তনের জন্য সবার আগে দরকার সুষম শিক্ষা। ইসলাম বিয়ের জন্য যে সুন্দর পদ্ধতি প্রণয়ন করেছে, তা অনুসরণ করতে পারলে এখানকার সমাজে বিয়েটা কত্তো সহজ হয়ে যেতো!
শুধু লেখালেখি কিংবা ওয়াজ দিয়ে আর হবে না। যুবকদেরকে নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে সচেতনতা ও প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করতে হবে।
সুন্দর লিখেছেন।এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া অতীব জরুরি
যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি যা আমাদের সমাজ কে কলুষিত এবং ধ্বংস করে দিচ্ছে । ।কিছু দিনের সুখের আশায় অনন্তকাল দুঃখ নিয়ে আসে।
যৌতুক বর্তমানে উভয় পক্ষের কাছে একটা স্বাভাবিক বিষয়। কারণ তারা এটাকে যৌতুকই মনে করে না। তারা ভাবে এটা তো যাস্ট খুশি হয়ে কিছু দেওয়া। কিন্তু মনে থাকে লোভ।
এই একটা কারনে আজ আমাদের সমাজে অনেক পরিবার সঠিক সময়ে অনেক মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছে না। এই সমাজে একটা মেয়ে বিয়ে দেওয়া মানে একটা পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে জবাই করে দেওয়দর সমান। পরে এর লেশ ধরে মেয়ের পরিবারে নেমে আসে নানাবিধ সমস্যা, যা একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের যুবকদের এগিয়ে আসা উচিত।
আরিফ আজাদ ভাইয়া, “বাল্য বিবাহ বন্ধ করুন” এই স্লোগান নিয়ে যারা কাজ করতেছে এ বিষয়ে কিছু লিখার অনুরোধ রইলো।
আল্লাহ আপনার জ্ঞানে বারাকাহ দান করুক।আ’মীন।
দুঃখ লাগে চট্টগ্রামে জন্মেছি তাই।অনেক বন্ধুবান্ধব সহপাঠী যাদের বাড়ি বিভিন্ন জেলায় তারা এসমস্ত কথা শুনলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।খুবই আফসোস আর কষ্টের সাথে বলতে হয়।কীযে বলব ভাষা নেই ভাইয়া।
আল্লাহ আপনি আমাদের প্রতি রহম করুন।