(১)
আমার কাছে অনেকে আক্ষেপ করে বলেন তারা নাকি শুনবার মতো যথেষ্ট ভালো ওয়াজ বা লেকচার কোথাও খুঁজে পান না। আমি যখন বলি, ‘কেনো, ইউটিউব ভর্তি এতো এতো ওয়াজ আর লেকচার থাকতেও খুঁজে না পাওয়ার কারণ কী?, তারা তখন বলেন, ‘ভাই, কাঁদা ছোড়াছুঁড়ির জন্যে সেসব জিনিস দেখতে ভালো লাগে না। কে কাকে কতো জোর গলায় অপমান-অপদস্থ করে কথা বলতে পারেন সেই প্রতিযোগিতা চলে বেশিরভাগ সময়। শ্রোতারাও কী মুগ্ধতা নিয়ে শুনে যান আর চিৎকার করে করে উৎসাহ দেন বক্তাদের! বলেন তো ভাই— এসব দেখে কি অন্তর নরম হবে না আরো কঠিন হয়ে উঠবে?’
না, ইউটিউব বা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে ভালো ওয়াজ কিংবা ভালো বক্তা যে নেই তা বলা যাবে না। তবে, পাশাপাশি ওয়াজের নামে ব্যক্তিবিদ্বেষ, দল-বিদ্বেষ সহ নানান বিদ্বেষের ছড়াছড়িও যে বিপুলভাবে সয়লাভ তা-ও অস্বীকারের জো নেই। ভিডিওগুলোর থাম্বনেইল ছবি দেখলেই অনেকসময় বুঝে ফেলা যায় ভেতরে বক্তা আসলে কী বলেছেন— ‘অমুককে নিয়ে কী বললেন তমুক’, ‘অমুকের হাতে ধরা খেলেন তমুক’, ‘এ কেমন কঠিন জবাব তমুকের’, অমুকের যে জবাব শুনে চুপসে গেলেন তমুক হুজুর’ সহ নানান ওয়াজ-নসিহতে সয়লাভ আমাদের ইউটিউব। এসব দেখে সচেতন মানুষের মন বিষিয়ে উঠা এবং এসবের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক বৈ কি!
একজন দায়ী কখনোই একজন সাধারণ মানুষের মতো নন। তাঁকে হতে হয় বিচক্ষণ, কৌশলী, মিতভাষী এবং আন্তরিক। তাঁকে মনে রাখতে হবে— যেনতেন ব্যাপার কিন্তু নয়, তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন ইসলাম নামের একটা পরিপূর্ণ দ্বীনের। তাঁর কথা বলার ঢঙ, আচরণ এবং ভাবের বিনিময়— সবকিছুতে মানুষ ইসলামের ছায়া দেখতে চাইবে। ঘরোয়া পরিবেশেও নয়, তিনি কথা বলছেন স্টেজে— হাজারো এবং লাখো মানুষের উপস্থিতিতে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে তিনি ছড়িয়ে পড়ছেন আরো হাজার-লাখো মানুষের কাছে। এরকম অবস্থায় একজন দায়ীর উচিত প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি বাক্য মেপে মেপে বলা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য— এমন বিচক্ষণতা, কৌশল আর দাওয়াতের সুনিপুণ মাধুর্যতা আজ বিলুপ্তপ্রায়। মাইক সামনে পেলে আমরা কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠি। কমেডি করা, খলখল করে লোক হাসানো, অন্যকে পঁচিয়ে তৃপ্তি পাওয়া, গানের সুর নকল করে কথা বলা সহ কী নেই আজকালকার ওয়াজে? একটা মাহফিল কিংবা ওয়াজ থেকে একজন শ্রোতা আল্লাহর দ্বীনের বুঝ নিয়ে ফিরবে। খুঁজে পাবে জীবনের উদ্দেশ্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে ভালোবাসা এবং সমানভাবে ভয় করার ব্যাপারে একজন শ্রোতা হয়ে উঠবে আরো মনোযোগি, আরো বদ্ধপরিকর। অন্তরগুলো নরম হবে, হৃদয়গুলো শীতল হবে, চোখগুলো অশ্রু ঝরাবে পাপ-মোচনের তাগাদায়। কিন্তু, দিনশেষে তা আদৌ হয় কি? তাহলে, কেনোই-বা মানুষেরা উত্তম বিকল্পের জন্য উদগ্রীব হবে না?
(২)
এখানে আমার মূসা আলাইহিস সালামের কথা মনে পড়ে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মূসা আলাইহিস সালামকে নবুয়ত দিলেন এবং ভাই হারুন আলাইহিস সালামকে নিযুক্ত করলেন তাঁর সহকারি হিশেবে। এরপর প্রথমবারের মতো মূসা আলাইহিস সালামকে তিনি পাঠাচ্ছেন যালিম ফিরআউনের কাছে। সেই ফিরআউন যে অবাধ্যতার সকল সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে গেছে। যে হত্যা করেছে বনি ইসরাইলিদের অসংখ্য নবজাতককে। বনি ইসরাইলিদের ওপরে যে করে যাচ্ছে নারকীয় সব অত্যাচার। যার ভয়ে একদিন মূসা আলাইহিস সালামকে ছাড়তে হয়েছিলো নিজের মাতৃভূমি। সবকিছুর ওপর— সেই ফিরআউন যে নিজেকে খোদা ঘোষণা করেছে! এমনই এক অবাধ্য যালিমের মুখোমুখি হওয়ার আদেশ পেলেন নবি মূসা আলাইহিস সালাম। কিন্তু, নির্দেশটা পেলেন কোন ভাষায়? কুরআন থেকেই শুনুন:
‘আপনারা উভয়ে ফিরআউনের কাছে যান। সে তো সীমালংঘন করেছে। আপনারা তার সাথে কথা বলবেন নম্রভাবে। হতে পারে সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে’।
ফিরআউন যে কোন মাত্রার যালিম তা কি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা জানেন না? তার এতো এতো কু-কীর্তি, অত্যাচার-নির্যাতন, কুফরের সর্বোচ্চ সীমায় আরোহন— এসবের কোনোটাই কি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে অজানা? একদম তা নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার চাইতে ফিরআউনকে ভালো আর কে জানেন? দুনিয়ার বুকে পদচিহ্ন রাখা সর্বশ্রেষ্ঠ যালিমের কাছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর দূত পাঠাচ্ছেন এবং বলে দিচ্ছেন— ‘তার সাথে কথা বলবেন নম্রভাবে’। আপনি কি চিন্তা করতে পারেন বিনয়ের কোন মাত্রা পর্যন্ত নিজেকে টেনে নেওয়ার নির্দেশ ইসলাম দেয়?
মানুষের একটা সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে শত্রুকে সম্মান দিতে চায় না। তাকে যতো প্রকারের অপমান-অপদস্থ আর নাজেহাল করা যায় তার সবটাই করবার এক অদম্য নেশা মানুষের মনে থাকে। কিন্তু নবি মূসা জীবনের সবচাইতে বড় শত্রুটার কাছে যখন যাচ্ছেন, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁকে বাড়তি করে বলে দিচ্ছেন— সে হতে পারে যালিম, হতে পারে সে সীমালংঘনকারী। কিন্তু তবু— তার কাছে গিয়ে আপনি অহংকার দেখাবেন না। তাকে আল্লাহর পথে আহ্বান করবেন বিনয়ের সাথে।
আমার কাছে মনে হলো— ফিরআউনের মতো হতচ্ছাড়া যালিমের সাথে যদি নবি মূসা আলাইহিস সালামকে বিনয় আর নম্রতা প্রদর্শন করতে হয়, আজকের সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের যে-সকল দায়ীরা কথায় কথায় তাদের অপর মুসলিম ভাই, দায়ী এবং আলিমদের কুপোকাত করে দিচ্ছেন, যাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছেন, উপহাসে মত্ত হচ্ছেন, যাদের ব্যাপারে ঠাট্টা করে সুরেলা গান গাইছেন মাইকের সামনে— সে সকল মানুষগুলো কি ফিরআউনের চাইতেও অধম আর নিকৃষ্ট হয়ে গেলো? নবি মূসা আলাইহিস সালামের কাছ থেকে যালিম ফিরআউন বিনয় আর নম্র ব্যবহার পায়, কিন্তু এখানে একজন দায়ী অন্য দায়ীকে বিনয় আর নম্রতা দেখাবে দূর, তাকে নিয়ে মজা-মস্করা করতেই যেন বদ্ধপরিকর।
দাওয়াতের এক অসাধারণ পন্থা নবি মূসা আলাইহিস সালামকে শিখিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। যতো বড় যালিম, মুনাফিক, শত্রু কিংবা প্রতিপক্ষই হোক, একজন দায়ী তার কথায় বিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখাবেন। তার ভাষায় থাকবে নম্রতার ছাপ। তিনি উগ্র হবেন না, মেজাজ হারাবেন না, হবেন না অস্থির-চিত্ত। ফিরআউন তো অবাধ্যতার সকল সীমা ছাড়িয়েছিলো, তাকে শুধরাবার জন্যে যে পদ্ধতি নবি মূসাকে শিখিয়ে দিচ্ছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তা হলো এই— ‘তার সাথে কথা বলবেন বিনয় আর নম্রভাবে’।
ফিরআউনের ভুল তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার এই যদি হয় পদ্ধতি, তাহলে আমাদের কোন ভাই যদি ভুল কোনোকিছু বলেন, যদি আমাদের কোন দায়ীর দ্বারা ভুল কোন বার্তা ছড়ায় বা ভুল কোন পথে যদি তিনি মানুষকে প্রভাবিত করেন, তার সেই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিটা কেমন হওয়া উচিত আমাদের? নবি মূসা আলাইহিস সালামের কাছ থেকে ফিরআউন যদি বিনয় আর নম্রতা পাওয়ার অধিকার রাখে, আমাদের অপর মুসলিম ভাই, যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে বিশ্বাস করে, যার ব্রত-উদ্দেশ্য আল্লাহর দ্বীনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া, তার কোন ভুল শুধরাতে গেলে আমাদেরকে বিনয়ের কেমন পরাকাষ্ঠা দেখানো উচিত? আমাদের যে ঈমানদার ভাই, যে তাকওয়াবান দায়ী, যে মুখলিস আলিম কোন ভুল করেন, তিনি কি ফিরআউনের চাইতে হাজারো-কোটি গুণে ভালো নন আল্লাহর চোখে? যদি তা-ই হবে, তাহলে কেনো আমাদের এসব হাসি-তামাশা-মস্করা? অন্যকে খাটো করে কেনো আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি?
আমাদের নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মুমিনদের প্রতি বড়োই দয়াশীল। সূরা আলে-ইমরানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন:
‘আল্লাহর পরম অনুগ্রহ যে আপনি তাদের প্রতি দয়ার্দ্র রয়েছেন। যদি আপনি কর্কশভাষী আর কঠিন হৃদয়ের হতেন, তাহলে তারা আপনার সঙ্গ ত্যাগ করতো’।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা স্পষ্ট করেই বলছেন— নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি মুমিনদের সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলতেন এবং তিনি যদি উদার না হয়ে কঠিন হৃদয়ের মানুষ হতেন, তাহলে মুমিনরা তাঁর সাথে মিশতো না। তাঁর কোন কথাই শুনতো না— তা ভালো হোক কিংবা মন্দ, সঠিক কিংবা ভুল।
মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে কোমলতা আর সরলতা পছন্দ করে। যে কর্কশ ভাষায় কথা বলে এবং ব্যক্তি হিশেবে যে কঠিন হৃদয়ের মানুষ, সে যতো ক্ষমতাবান-ই হোক, মানুষ তাকে এড়িয়ে চলবেই। মানুষকে বশে আনার অনুপম গুণগুলোর একটা হলো তাদের প্রতি ভালোবাসা, মায়া আর স্নেহ প্রদর্শন। এসব ব্যতিরেকে কোনোদিন কাউকে আপন করে কাছে পাওয়া যায় না। জোর করা যায়, কিন্তু স্বতস্ফূর্ততার সাথে অংশগ্রহণ তাতে থাকে না।
কোমলতা, বিনয় আর নম্রতা আল্লাহর প্রেরিত নবি-রাসূলদের গুণ। তারা কথার মায়ায় আকৃষ্ট করতেন লোকদের। তাদের বিনয় আর নিরহংকারের কাছে মানসিকভাবে পর্যদুস্ত হয়ে পড়তো অহংকারি রাজা বাদশারাও। কাজ দিয়ে অন্তর জয় করার আগে কথা দিয়েই তা জিতে নিতে হয়।
সোশ্যাল মিডিয়াতে যারা আজ দাওয়াতের ভূমিকায়, তাদের ওয়াজে, লেকচারে, বক্তৃতায় নিঃসন্দেহে অনেক ভালো জিনিস, উপকারি জ্ঞান ছড়ানো থাকে। কিন্তু তাদের কথায় যখন অন্যের ব্যাপারে বিদ্বেষ, রূঢ়তা আর কটু-বাক্য থাকে, তখন সেই উপকারি জ্ঞানটুকুর বার্তা ম্লান হয়ে পড়ে। ভালো বিষয়গুলোও তখন হৃদয়পট থেকে হারিয়ে যায়।
ফিরআউন যদি নবি মূসার কাছ থেকে বিনয় আর নম্রতা লাভ করতে পারে, আমাদের আরেক মুসলিম ভাই, দায়ী আর আলিম কি আমাদের কাছে সেটা প্রত্যাশা করতে পারেন না?
আলহামদুলিল্লাহ। আজকের দিনে এসব বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করার মত চমৎকার মনের একজন আছেন জেনে ভালো লাগে।
মাশাল্লাহ ── আপনি হামেশাই গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো নিয়ে লিখেন! এজন্য আপনাকে ভালো লাগে ❤️
আমার মনে হয় আমাদের মন্তব্য গ্ুলা আরিফ ভাই দেখে না ।
আপনার লেখা যতই পড়ি ততই নতুন কিছু শিখছি।
নিজের অভিজ্ঞতার থেকে কোনো কিছু শিখতে পারি নি। যাহা কিছু রপ্ত করতে পেরেছি সবকিছুর পেছনে হাত রয়েছে “আরিফ আজাদ ভাইয়ের।
খুবই মনোমুগ্ধকর লেখা।
আপনার লেখা পড়ার জন্য সব সময় মুখিয়ে থাকি , বিশেষ করে ফেইসবুক ডিলেট করে দেওয়ার পর থেকে । মাঝে মধ্যে ওয়েব সাইট ভিজিট করে আক্ষেপ করতাম, ইস এখানে যদি নিয়মিত লেখা পাবলিশ করতো! আলহামদুলিল্লাহ আপনার নতুন লেখা গুলো পেয়ে ভালো লাগছে।
মা’শাআল্লাহ, অসাধারণ লেখনি💚
💚💚